হাদীসের মাজহাবি নামাজে কুরআন বিরোধী ১০ পদ্ধতি ( সালাত পর্ব ৫)

সালাত

সকল প্রশংসা সমগ্র বিশ্বের প্রতিপালক মহান আল্লাহর জন্য, যিনি পরম দয়ালু, অসীম দয়াময়। আজ আমাদের আলোচনার বিষয়—মাযহাবের লাইলাতুল ইলেকশন, মাযহাব রহস্য, এবং মুসলিম উম্মাহর সাথে ১০০০ বছর ধরে যে ধোঁকা, যেই ধোঁকাবাজি, যে প্রতারণা, যেই বাটপারি করা হচ্ছে, সেই বিষয়ে আমরা আলোচনা করব।

পৃথিবীর ইতিহাসে একটা মাত্র নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। যেই নির্বাচনে ২০ জন ক্যান্ডিডেটের মধ্যে চারজন ক্যান্ডিডেট জয় লাভ করেছে। মানে, একটা দেশের প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচন হবে—সেই প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনে চারজন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। মানে, শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া, নুরুল হক নূর, এবং হোসেন মোহাম্মদ এরশাদ—চারজন দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। কারণ কী? কারণ, চারজন সমান সংখ্যক ভোট পেয়েছেন। ক্যান্ডিডেট দাঁড়িয়েছিলেন কতজন? ২০ জন।

এরকম একটা গল্প যদি আপনাকে বলা হয়—মানে, আজ থেকে ১০০ বছর পরের কোনো জেনারেশনকে বলে—কেউ বিশ্বাস করবে না যে, ১০০ বছর আগে বাংলাদেশ নামক একটা দেশে এমন একটা নির্বাচন হয়েছিল, যেই প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনে ২০ জন ক্যান্ডিডেটের মধ্যে চারজন জয় লাভ করেছে এবং চারজন প্রধানমন্ত্রী ছিল। তারা দেশ চালিয়েছিল। এই গল্প যদি কাউকে বলা হয়, সেই প্রজন্ম এই গল্প যিনি বলেছেন, তাকে গাঁজাখোর, মদখোর, নেশাখোর, মাতাল, পাগল‑ছাগল ছাড়া অন্য কিছু বলবে না।

কিন্তু গত ১০০০ বছর ধরে আমাদেরকে এমনই এক ইলেকশনের গল্প শোনানো হচ্ছে, যেই ইলেকশনে চারজন নির্বাচিত হয়েছেন। আর আমরাও সেই ননসেন্সের মতো, গাঁধার মতো, পাগল‑ছাগল, বরবরদের মতো সেই নির্বাচনকে সত্যিকার নির্বাচন হিসেবে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে নিয়েছি। এবং মনে করছি, এই চারজন হচ্ছেন আদর্শ সন্তান, মহান নেতা। এই মহান নেতা—আরবিতে যাকে বলা হয় “ইমাম”—এই মহান চারজন ইমামের, মহান চারজন নেতার যেকোনো একজন নেতার আদর্শ অনুসরণ করলেই আমি সিরাতুল মুস্তাকিমে চলে যাব।

আপনাদের আজকে গল্প বলছি—“চার মাযহাবের ইলেকশন”। বলা হয়ে থাকে, মানে আমাদের আলেম‑ওলামারা আমাদেরকে বলেন ওয়াজের স্টেজে: “চার মাযহাবই সঠিক। ইমাম আবু হানিফা, শাফি, মালিক, হাম্বল—কিভাবে সঠিক? কারণ তারা চারজনই হকের পথে, সত্যের উপরে আছেন।”

তখনকার সময়ে তো আরো ১৬টা মাযহাব ছিল। মোট ২০টা মাযহাব ছিল। বাকিরা বেঠিক। এই চারজনই সঠিক। চারজন কিভাবে সঠিক হলো? উত্তর হচ্ছে, আলেম‑ওলামাদের ইজমার মাধ্যমে। ইজমা মানে ঐক্য, ঐক্যমত্য। মানে, আলেম‑ওলামাদের ইজমা হয়েছে, ঐক্যমত হয়েছে। সেই ঐক্যমতের ভিত্তিতে তারা রায় দিয়েছেন যে, চারজনই হক এবং চারজনই সঠিক। যেকোনো একজনকে অনুসরণ করলে, যেকোনো একজনকে নেতা (অবিসংবাদিত নেতা বা ইমাম) মানলে, আপনার জীবন সাকসেস। তাদেরকে মানা মানেই হচ্ছে রাসূলকে মানা।

হাজার কোটি টাকার প্রশ্ন: যে ইজমার ভিত্তিতে চারজনকে সঠিক ঘোষণা করা হয়েছে, সেই ইজমা—সেই ঐক্যমত—সেই মহাসম্মেলনে পৃথিবীর কোন দেশে, কত সালে, কত তারিখ, কয়টার সময় হয়েছে? এর উত্তর আপনাকে দিতে পারবে না। দ্বিতীয় প্রশ্ন: একটা মহাসম্মেলনে চারজন কিভাবে সঠিক হয়? তারা তো ইজমার মধ্যে যেকোনো একটাকে পারফেক্ট, একটাকে সহি-শুদ্ধ হিসেবে ঘোষণা দেবে।

একজন যদি বলে, “দুই আর দুই চার হয়”; আরেকজন যদি বলে, “দুই আর দুই পাঁচ হয়”; আরেকজন যদি বলে, “দুই আর দুই ছয় হয়”; আরেকজন যদি বলে, “দুই আর দুই সাত হয়”। আর যদি ইজমা করা হয়, ঐক্যমত মহাসম্মেলন করা হয়, আর যদি বলা হয়, “চারজন সঠিক”—যেই ঘোষণা দেবে, সে হচ্ছে একটা রাম‑ছাগল। কিন্তু এমনই এক আজগুবি গল্প আমাদের বলা হচ্ছে শত-শত, হাজার বছর ধরে।

এই চারজনের মহাসম্মেলন হয়েছিল—সেই মহাসম্মেলন (আলেম‑ওলামাদের মহাসম্মেলনে) ইজমার মাধ্যমে এই চারজন যে সঠিক, সেই ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। তাহলে সেই ইলেকশনের মতোই হয়ে গেল। যেই মহাসম্মেলনে এরকম রাতের বেলা ভোট হয়েছিল এবং সেই ভোটে এই চারজন সমসংখ্যক ভোট পেয়েছিলেন। ইমাম আবু হানিফা, শাফি, হাম্বল, মালিক—চারজন সমান সমান ভোট পেয়ে চারজনই নির্বাচিত হয়েছিলেন। চারজনই দেশের নেতা হিসেবে, ইমাম হিসেবে তারা নির্বাচিত (জয়যুক্ত) হয়েছিলেন। এজন্যই সেই নেতা বা ইমাম হিসেবে আমরা বলি: “ইমাম আবু হানিফা”, “ইমাম মালিক”, “ইমাম শাফি”, “ইমাম হাম্বল”। এই গাঁজাখুরি গল্প আমাদের গেলানো হচ্ছে ১০০০ বছর ধরে!

নামাজের নিয়মে মাযহাবভিত্তিক বৈপরীত্য ও সমাধান

  • আমিন বলার পদ্ধতি:
    হানাফী, মালিকি ও হাম্বলি মাযহাব অনুযায়ী আমিন আস্তে বলা সুন্নত। শাফি মাযহাব অনুযায়ী জোরে বলা ওয়াজিব। প্রশ্ন হলো: ইমাম ও মুক্তাদি উভয়ের আমিন একসাথে কীভাবে বৈধ হয়? চার মাযহাবের “ইলেকশন” নামক এই গল্পে সমসংখ্যক ভোটে “নির্বাচিত” চার ইমামের বিধান পরস্পরবিরোধী হওয়া সত্ত্বেও সবাই “সঠিক”!
  • বিতির নামাজের অবস্থান:
    ইমাম আবু হানিফার মতে বিতির নামাজ পড়া ওয়াজিব (যা কোরআন‑হাদিসে সরাসরি উল্লেখ নেই)। অন্যদিকে মালিকি, শাফি ও হাম্বলি মাযহাব অনুযায়ী এটি সুন্নত। “ওয়াজিব” শব্দটি ফিকহি আবিষ্কার, যা আল্লাহর সরাসরি আদেশ (ফরজ) বা রাসূলের সুন্নত নয়।
  • জামাতের নিয়ম:
    হানাফী মাযহাব অনুযায়ী জুমার নামাজের জন্য ইমামের পিছনে ৩ জন মুসল্লি যথেষ্ট। শাফি ও হাম্বলি মতে ৪০ জন, মালিকি মতে ১২ জন। এই সংখ্যাগুলো কোথা থেকে এসেছে? সাহাবা-তাবেইনদের আমলে এমন সংখ্যাগত বিধান ছিল না।
  • স্থিরতা (তুমানিনাত):
    রুকু-সিজদায় স্থির থাকা হানাফী মাযহাবে ওয়াজিব, অন্যদিকে মালিকি, শাফি ও হাম্বলি মতে ফরজ। এই পার্থক্যের ভিত্তি কী? কোরআন‑হাদিসে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা না থাকায় মাযহাবগুলোর নিজস্ব যুক্তি প্রাধান্য পেয়েছে।

মহাসম্মেলনের রহস্য: ইজমা নাকি রাজনীতি?

  • চার মাযহাবের ঐকমত্য (ইজমা):
    ১০০০ বছর ধরে বলা হয়, “মহাসম্মেলনে” আলেমদের ইজমার মাধ্যমে চার মাযহাব সঠিক ঘোষিত হয়। কিন্তু সেই সম্মেলনের কাল, স্থান, উপস্থিতির রেকর্ড কারো জানা নেই! বস্তুত, এটি একটি কাল্পনিক কাহিনী, যা মাযহাবের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।
  • পরস্পরবিরোধী ফতোয়া:
    দুই ওয়াক্ত নামাজ একত্রে পড়া হানাফী মতে নাজায়েজ, কিন্তু মালিকি-শাফি-হাম্বলি মতে জায়েজ। একইভাবে, মহিলাদের ইমামতি শাফি-হাম্বলি মতে জায়েজ, হানাফীতে মাকরুহ, মালিকি মতে নাজায়েজ। প্রশ্ন: আল্লাহর দ্বীন কি এতটা বিভ্রান্তিময়?

কুরআনের আলোকে নবীদের ডাকার বৈধতা প্রশ্নে মাযহাবী মতবিরোধ

  • দুরুদ ও শিরকের সীমারেখা:
    সূরা জিন ১৮-২০ এ আল্লাহ স্পষ্ট বলেন: “মসজিদগুলো শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য। সুতরাং তাঁর সাথে অন্য কাউকে ডেকো না।” কিন্তু নামাজে আত্তাহিয়াতুতে নবীর প্রতি সালাম (“আসসালামু আলাইকা আইয়্যুহান নাবিয়্যু”) পাঠ করা হয়, যা আল্লাহর সাথে অন্যকে ডাকার শামিল। এটি কি শিরক নয়?
  • সূরা আহযাব ৫৬-এর অপব্যাখ্যা:
    আল্লাহ ও ফেরেশতারা নবীর উপর সল্লু (দয়া) করেন বলে মুসলিমরা নবীর জন্য দুরুদ পাঠকে ফরজ মনে করে। কিন্তু সল্লু শব্দের অর্থ “দয়া” বা “সমর্থন”, যা আল্লাহই প্রদান করেন। অথচ মানুষ “আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদ” বলে আল্লাহকেই আদেশ দেয়, যা চরম বেয়াদবি!

হাদিসের নামে কুরআন‑বিরোধী আমল: একটি পর্যালোচনা

  • আত্তাহিয়াতুর উৎস:
    নামাজে আত্তাহিয়াতু পাঠ করা হয় হাদিসের ভিত্তিতে, যা কোরআন‑বিরোধী। সূরা জিন ১৮ অনুযায়ী, নামাজে শুধুমাত্র আল্লাহকেই ডাকা বৈধ। কিন্তু নবীর প্রতি সালাম ও দুরুদকে “সুন্নত” বলা হয়, যা কোরআনের মৌলিক শিক্ষার সাথে সাংঘর্ষিক।
  • কাউসারের আয়াতের অপপ্রয়োগ:
    সূরা কাউসারে “ফা-সাল্লি লি-রাব্বিকা ওয়ানহার” (তোমার রবের জন্য সালাত আদায় করো ও কুরবানি করো) আয়াতটি নামাজে পাঠ করা হয়। কিন্তু এখানে “সাল্লি” অর্থ “সমর্থন/দয়া করা”, যা আল্লাহ মুমিনদের উদ্দেশ্যে বলেন। মানুষ এটি নামাজের অংশ বানিয়ে আল্লাহকেই নির্দেশ দেয়, যা বানোয়াট প্রথা।

মৃত্যুপরবর্তী সওয়াব প্রেরণের গোঁজামিল: ইলমি ফাঁকফোকর

  • ইলম‑সিজিনের মিথ:
    কবরে সওয়াব পৌঁছানোর জন্য কুরআন খতম, দান‑সদকা ইত্যাদির প্রচলন রয়েছে। কিন্তু সূরা নাজম ৩৯ এ বলা হয়েছে: “মানুষ তার চেষ্টার ফল ছাড়া কিছুই পাবে না।” কবরে আমলনামা লেখা বন্ধ হয়ে যায়, তাই মৃত্যুর পর কারো পক্ষে সওয়াব পাঠানো অসম্ভব।
  • হুজুরদের ধান্দাবাজি:
    মোল্লারা টাকার বিনিময়ে “কবরে সওয়াব পৌঁছানো”-র নামে ব্যবসা চালায়। এটি সূরা তাওবা ৩৪‑এ নিন্দিত “ধর্মব্যবসা”। আল্লাহর বিধান সরল: জীবিত থাকতে নিজে নেক আমল করুন, মৃত্যুর পর কারো সাহায্য আসবে না।

কুরআনের দৃষ্টিতে নামাজ: বিশুদ্ধ আমলের আহ্বান

  • সালাতের প্রকৃত রূপ:
    কুরআনে নামাজের লক্ষ্য হলো আল্লাহর সাথে সরাসরি সম্পর্ক (সূরা মুজাম্মিল ১‑৯)। কিন্তু মাযহাবী কাঠামোয় দুরুদ, মাসুরা দোয়া, নবীর সালাম ইত্যাদি ঢুকিয়ে নামাজকে জটিল ও শিরকময় করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন: “আমি মানুষ ও জিনকে শুধু আমার ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছি” (সূরা জারিয়াত ৫৬)।
  • সমাধানের পথ:
    ১. কুরআনকে একমাত্র মাপকাঠি মানা।
    ২. মাযহাবী জটিলতা পরিহার করে সরলভাবে নামাজ আদায়।
    ৩. নবীর জীবনী থেকে শিক্ষা নেওয়া, কিন্তু তাঁর প্রতি অতিরিক্ত মর্যাদা না দেওয়া।
    ৪. আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ডাকা বা সাহায্য চাওয়া থেকে বিরত থাকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *