প্রস্তুতি ও নির্দেশনা
সকল প্রশংসা সমগ্র বিশ্বের প্রতিপালক মহান আল্লাহর জন্য যিনি পরম দয়ালু অসীম দয়াময়। বেক্সিমকো ফ্যাক্টরির মালিক সালমান এফ রহমান সাহেব। ফ্যাক্টরির বয়স প্রায় ২৫ বছরের বেশি, মালিকের বয়স ৭০ বছর। তার ফ্যাক্টরির পুরনো এবং বিশ্বস্ত ম্যানেজার হলো ফারুক সাহেব। মালিক সালমান সাহেব এবার ঠিক করেছেন টানা দুই মাসের জন্য তিনি ফ্যাক্টরির নিয়মিত কাজ থেকে বিরতি নিয়ে প্রথমে সৌদি আরব যাবেন, সেখানে হজ করবেন এবং সেখান থেকে আমেরিকায় যাবেন। তার মেয়ে, মেয়ে জামাই ও নাতিদের সাথে সময় কাটাবেন।
দীর্ঘ দুই মাস তার ফ্যাক্টরির কাজকর্ম থেকে অনুপস্থিত থাকা নিয়ে সালমান সাহেবের জন্য কিছু দুশ্চিন্তার হলেও, তিনি এই সময়ে তার ফ্যাক্টরির সিনিয়র অফিসারদের কার কি কাজ, দায়িত্ব, কর্তব্য, কোন সমস্যা হলে কিভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, কার সাথে যোগাযোগ করতে হবে—এ সবকিছু খুব পরিষ্কার করে একটা চিঠিতে লিখে সবাইকে সেটা পৌঁছে দিয়েছেন।
সাথে এটাও স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, “আমার অনুপস্থিতিতে এই ১০ পাতার চিঠিটাই তোমাদের প্রত্যেকের জন্য গাইডলাইন। আশা করি তোমরা এই চিঠি নিয়মিত পড়বে, এখান থেকেই নিজেদের করণীয় বুঝে নেবে। তাহলেই এই ২৫ বছরের ফ্যাক্টরিতে রেগুলার কাজের কোন ব্যাঘাত ঘটবে না। কর্মচারীরা শান্তিতে কাজ করতে পারবে আর তোমরা নিজেরাও খুব ভালো থাকবে।”
অদ্ভুত রীতি ও বিভ্রান্তি
ওই চিঠি-প্রাপ্তদের মধ্যে পুরনো এবং বিশ্বস্ত ম্যানেজার ফারুক সাহেব একজন। সালমান সাহেবের বিদেশে চলে যাওয়ার পর একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো ফ্যাক্টরিতে। ফ্যাক্টরির মালিকের বিদেশ চলে যাওয়ার পরের দিন, ম্যানেজার ফারুক সাহেব প্রতিদিন তার মালিকের রেখে যাওয়া চিঠিখানা খুলে খুব আবেগে একবার প্রথমেই চুমু খেয়ে নেয়। তার অফিস কামরার সবচেয়ে উঁচু যে তাক, তার উপরে রাখে; নিচে বা ডেস্কে অন্য কাগজের সাথে রাখে না—পাছে বসের অপমান না হয়ে যায়।
সুন্দর করে রাখার জন্য সে আবার আলাদা একটা বক্স অর্ডার দিয়ে বানিয়েছে, যেন চিঠিটায় কোন ধুলোবালির স্পর্শ না হয়। হাজার হোক, বসের চিঠি! দিনের নির্দিষ্ট কিছু সময়ে ফারুক সাহেব বসের রুমে চলে যান। সেখানে সে চিঠিটাকে সযত্নে বাক্স থেকে বের করে বসের চেয়ারের দিকে মুখ করে খোলেন—মানে বসের চেয়ারটাই এখন তার কিবলা। সেই কিবলার দিকে মুখ করে চিঠিটাকে বাক্স থেকে বের করে খোলেন। তারপর খুব চমৎকার সুরে ছন্দ নিয়ে, মনের আবেগ ও মাধুরী মিশিয়ে কবিতা আবৃত্তি করার মতো করে সেই চিঠি শুদ্ধ ও প্রমিত উচ্চারণে তিনি আবৃত্তি করেন। প্রতিটা শব্দের বর্ণের দাড়ি-কমায় তার প্রচণ্ড মনোযোগ।
বসের চেয়ারকে লক্ষ্য করে চিঠিটা অফিস সময়ের ভেতরে তিনবার অন্তত পাঠ তিনি করবেনই। মাঝেমধ্যে আবেগে চিঠিটার অক্ষরগুলায় হাত বোলানো। তিনি বসের হাতের লেখা কত সুন্দর, সেটা নিয়ে মনে মনে খুব তারিফ করেন। এটা এখন তার রুটিনে পরিণত হয়েছে। বসের এবং বসের পরিবারের জন্য একটা ছোট্ট প্রশংসামূলক দুরুদ শরীফ (মানে ছোট্ট কবিতা) ওই চিঠি শেষ করে প্রতিদিন তিনি পাঠ করেন।
যেহেতু বিশ্বস্ত ও পুরনো কর্মচারী ফারুক সাহেব, করেন বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট থেকে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার, সাব‑ম্যানেজার ও অন্যান্য অফিসাররাও তার পেছনে লাইন ধরে। তারাও মোটামুটি একটা শিডিউল করে ফেলেছেন এই নতুন প্রোগ্রামে—যেখানে তারা বসের রুমে বসের চেয়ারের দিকে কিবলা করে (মানে সেই দিকে ফিরে), তাদের জন্য লেখা বসের চিঠি বসের চেয়ারকেই খুব সুন্দর করে ছন্দ নিয়ে মনের আবেগ‑মাধুরী মিশিয়ে সেই চেয়ারটাকেই তারা শোনান।
প্রতিদিন নির্দিষ্ট একটা টাইমে রুটিন করে এই কাজটা করার কারণে তাদের মধ্যে একটা হিপ্নোটিক ইফেক্ট তৈরি হয়েছে। কারণ আমরা সবাই জানি, সাইকোলজিতে কোন কাজ যদি মানুষ প্রতিদিন রেগুলার করে, তাহলে সে কাজের একটা হিপ্নোটিক ইফেক্ট তৈরি হয়। আপনি যখন কোন কাজ যান্ত্রিকভাবে দিনের পর দিন করতে থাকেন, তখন একসময় সবাই ভুলে যায় সে কেন করছে ওই কাজটা।
বাস্তবতা বিস্মৃতির গল্প
ওই হিপ্নোটিক ইফেক্টে একসময় বেক্সিমকো ফ্যাক্টরির সব ম্যানেজার, সব অফিসার বেমালুম ভুলে গেছেন যে তাদের ওই চিঠি বসের চেয়ারের জন্য নয়, বসের চেয়ারকে শোনানোর জন্য নয়। ওই চিঠি তাদের নিজেদের জন্য। ওই চিঠি তাদের জন্য নির্দেশনা। ওই চিঠি কেবল সুর করে পাঠ করায় কোন উপকার নেই, কোন বেনিফিট নেই। বরং বাস্তব সমস্যার সমাধান কিভাবে করবে, কিভাবে তাদের ফ্যাক্টরির কাজ পরিচালনা করবে—তার মধ্যে ওই চিঠির আসল উদ্দেশ্য লুকিয়ে আছে।
ওই ফ্যাক্টরিতে এই দুই মাসে অনেক ধরনের ক্রাইসিস তৈরি হয়েছে। মালিক যা যা আশঙ্কা করেছিল, তা তো হয়েছেই; আরো অনেক ধরনের অতিরিক্ত ক্রাইসিসও যুক্ত হয়েছে। এক্সপোর্ট সময় মতো হচ্ছে না, এলসি সময় মতো প্রসেস হচ্ছে না, ব্যাংকে টাকা আটকে আছে, কর্মচারীরা বেতন দেরি হওয়ার জন্য স্ট্রাইকে যাওয়ার পায়তারা করছে—আরো কত ধরনের সমস্যা! সমস্যার অন্ত নেই। সব মিলিয়ে ফ্যাক্টরি এখন পথে বসে যাওয়ার অবস্থা।
এদিকে আমাদের বিশ্বস্ত ম্যানেজার কিন্তু সকাল‑দুপুর ও বিকাল রুটিন করে ওই চিঠি পাঠ অব্যাহত রেখেছেন। তার এই প্রোগ্রামের নাম দিয়েছেন “চিঠি খতম প্রোগ্রাম”। যে যত বেশি চিঠি খতম করতে পারছে, তার জন্য আলাদা একটা পয়েন্ট সিস্টেম এইচআর ডিপার্টমেন্ট ঠিক করে নিয়েছে। সম্ভবত তাদেরকে আলাদা একটা বোনাসও দেয়া হবে। তাদের মনে অনেক বড় আশা যে মালিক নিশ্চয়ই ফিরে আসার পর তাদের এই চিঠি পাঠ‑খতমের পুরস্কার দেবেন।
কোরআনের আসল উদ্দেশ্য
মহান আল্লাহ সেমিটিক জাতির মধ্যে বিধান নাযিল করেছেন। একটা হলো তাওরাত নবী সালামুন আলাইহি মুসার মাধ্যমে, অন্যটা ইঞ্জিল নবী সালামুন আলাইহি ঈসার মাধ্যমে। একটা হলো জাবুর নবী সালামুন আলাইহি দাউদের মাধ্যমে, আরেকটা হলো কোরআন নবী সালামুন আলাইহি মোহাম্মদের মাধ্যমে। যে কোরআন আমরা পেয়েছি, সেটা নিজেকে কি বলে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছে? কোরআন নিজেকে বলেছে পথনির্দেশক (হেদায়েত), সত্য‑মিথ্যার পার্থক্যকারী (ফুরকান), উপদেশ গ্রন্থ, প্রজ্ঞা বা হিকমতের গ্রন্থ—আরো অজস্র নাম।
এই কোরআন যদি আপনারা কেউ নিজ ভাষায় পড়ে থাকেন, তাহলে জানবেন যে এখানে লিগাল অর্থে আইন‑কানুন খুবই কম (হাতে গোনা)। এখানে বেশিরভাগ আয়াতই অনুপ্রেরণামূলক, উপদেশমূলক, যুক্তির কথাবার্তায় ভরা, প্রকৃতির নিদর্শন চোখ‑কান খুলে দেখে নেওয়ার আয়াতে পরিপূর্ণ। এই কুরআন মানুষের জন্য মানুষের ভাষায়, মানুষের সমাজের সমস্যা সমাধানের মূল নীতি নিয়ে নাযিল হয়েছে।
মানুষ কিভাবে চললে তার জীবনটা সুন্দর হবে, তার পরিবারটা সুন্দর হবে, তার সমাজটা সুন্দর হবে, তার রাষ্ট্রটা সুন্দর হবে—তার মাধ্যমে আশেপাশের সমস্ত জগত আলোকিত হবে। সেই মেসেজগুলাই কোরআনের পাতায় পাতায় দেয়া হয়েছে। মানুষের মনকে, তার চরিত্রকে, তার মানসিকতাকে সুন্দর করার জন্য আল্লাহ খুব কম সংখ্যক উপদেশ তাকে দিয়েছেন। কিন্তু সেই অল্প কয়টা উপদেশ যদি মানুষ মেনে চলে, তার জীবন হয়ে পড়বে ধন্য, এবং তার আশেপাশের মানুষগুলো তাকে পেয়ে হবে ধন্য।
অন্ধ অনুসরণের পরিণতি
যেমন সূরা নাহলের ৯০ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ বলছেন: “নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, ইনসাফ, সুন্দর ব্যবহার, ও আত্মীয়-স্বজনকে দানের হুকুম দিচ্ছেন এবং তিনি নিষেধ করছেন অশ্লীলতা, খারাপ কাজ ও সীমালঙ্ঘন। তিনি তোমাদেরকে উপদেশ দেন, যাতে তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করো।” আমরা দেখলাম কত চমৎকার কথা! আল্লাহ এই আয়াতটার শেষেই বলছেন, “তিনি তোমাদেরকে উপদেশ দেন।”
উপদেশটা কত সুন্দর! প্রথম উপদেশ: তোমরা ইনসাফ করবে, ন্যায়পরায়ণ হবে। দ্বিতীয় উপদেশ: তোমরা সুন্দর আচরণ করবে। তৃতীয় উপদেশ: তোমাদের আত্মীয়-স্বজনকে তোমরা দান করবে। আর তিনটা কাজ করতে তিনি নিষেধ করেছেন: এক. অশ্লীল কাজকর্ম, দুই. খারাপ কাজ (মন্দ কাজ, অসৎ কাজ), আর চার. বাড়াবাড়ি করা।
এই ছয়টা আদেশ ও নির্দেশ যদি পৃথিবীর যে কোন মানুষ মেনে চলে, তার পুরো কোরআন দরকার নেই। শুধু এই ছয়টা অর্ডার যদি সে পালন করে—আপনি ভেবে দেখেছেন, তার জীবনটা কত সুন্দর হবে? এবং তার আশেপাশের মানুষ, তার আশেপাশের সমাজ‑রাষ্ট্র কতটা উপকৃত হবে? মৃত্যুর পরের জান্নাতের দরকার নেই—এই পৃথিবীটাই জান্নাতে পরিণত হবে শুধুমাত্র এই একটা আয়াত যদি সে জীবনে বাস্তবায়ন করে!
চূড়ান্ত সতর্কবার্তা
সূরা নাহল আয়াত ৯০—এরকম খুব ছোট ছোট আদেশ‑নির্দেশ আল্লাহ মানুষকে দিয়েছেন, যেগুলো বেশিরভাগই তার চারপাশটাকে সৌন্দর্যময় করার জন্য, পৃথিবীটাকে আরো স্বপ্নীল‑বর্ণিল করার জন্য। ওই যে ফ্যাক্টরির কথা বলা হলো বেক্সিমকো ফ্যাক্টরি, সালমান এফ রহমানের—ঠিক সে রকম আমরা আল্লাহর বাণী আল্লাহকেই সুর করে শোনাতে ব্যস্ত। সেই নির্দেশনা, পথনির্দেশ, হেদায়েত, উপদেশ কী—তা নিয়ে আমরা একেবারেই বেহুশ, একেবারেই বেখেয়াল।
বরং, আমাদের ভেতরে কিছু মানুষ শয়তানের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য আমাদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে কোরআন না বুঝলেও ঠিক আছে—প্রতি অক্ষরে অক্ষরে নেকি, বর্ণে বর্ণে নেকি! খেয়াল করেন—শুধুমাত্র এই একটা ট্রেন্ড, এই একটা ডকট্রিন, এই একটা সিস্টেম চালু করার ফলে, সিস্টেমটা কি? যে কোরআন বুঝে পড়ার দরকার নেই। শুদ্ধ ও সহি উচ্চারণে কোন বোঝাপড়া ছাড়াই শব্দ উচ্চারণ করলেই সওয়াব! যাদের ভাষা আরবি নয়, সেই সমস্ত মুসলিমের কাছে এই কোরআনের বাণী চিরতরে বুঝতে না দেয়ার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করা হয়েছে।
অন্তিম প্রত্যাশা
আর এই যে ট্রেন্ড, এই যে ডকট্রিন, এই যে পদ্ধতি, এই যে সিস্টেম চালু করা হয়েছে যে শুদ্ধ‑সহি উচ্চারণে পড়লেই সওয়াব, এবং উচ্চারণ সহি-শুদ্ধ না হলে নামাজ কবুল হবে না—তাহলে কি করবে? আসো, মাদ্রাসা চালু করতে হবে—আলিয়া মাদ্রাসা, কওমি মাদ্রাসা, ইবতেদায়ী মাদ্রাসা। সেখানে তোমাদের কি করা হবে? সহি-শুদ্ধ উচ্চারণ শেখানো হবে, কিন্তু কোরআন বোঝানো হবে না। বোঝানো হবে লক্ষ‑লক্ষ হাদিস।
সেগুলো তোমাদের মুখস্ত করানো হবে। তোমরা কোরআনের জ্ঞানে আলোকিত হবে না, তোমরা হাদিসের জ্ঞানে আলোকিত হবে। তোমরা হয়ে যাবে শাইখুল হাদিস, শাইখুল কোরআন—তোমরা হবে না! এইভাবে ইবলিশের মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়ন করা হচ্ছে সমগ্র পৃথিবীব্যাপী।