নামাজ সম্পর্কে অজ্ঞতা ও ভুল বোঝাবুঝি
আমরা এর আগে প্রথম পর্বে নামাজ সম্পর্কে আলোচনা করেছিলাম সূরা নিসার ৪৩ আয়াত নিয়ে এবং সেই সংশ্লিষ্ট আরো ১০-১৫টি আয়াত নিয়ে। আমরা আলোচনা করে বুঝেছিলাম যে না বুঝে নামাজ পড়লে কী ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন আমাদের হতে হয় এবং নামাজে আমরা কীভাবে আল্লাহর সাথে ধৃষ্টতা করি, বেয়াদবি করি। না বুঝে নামাজ পড়ার কারণে আমরা নামাজের আধ্যাত্মিক স্বাদ ও তৃপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছি।
আজ দ্বিতীয় পর্ব: সালাত বা নামাজ—দুটো শব্দই আমাদের কাছে বিদেশী ভাষা এবং সমভাবে অজ্ঞাত। অর্থ আমরা ৯৯% মানুষই বুঝি না। যেহেতু সে কারণেই আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে: নামাজ কীভাবে পড়বো? কী পড়বো? হাত কতখানি উঠাবো? বুকে বাঁধবো না পেটে বাঁধবো? জুব্বা পড়বো না পাঞ্জাবি পড়বো? টুপি গোল পড়বো না লম্বা পড়বো? যদি আমরা নামাজ‑সংলগ্ন প্রতিটি শব্দের অর্থ বুঝতাম, তাহলে দেখতাম নামাজ কত চমৎকার একটি জিনিস!
কুরআনের নির্দেশনা: রুকু-সিজদার প্রকৃত অর্থ
সূরা হাজের ৭৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন: “হে মুমিনগণ! তোমরা রুকু করো, সেজদা করো, তোমাদের পালনকর্তার ইবাদত করো এবং সৎ কাজ করো—নেক আমল করো—যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো।” এই আয়াতটি যদি ভালোভাবে বোঝা যায়, তাহলে নামাজের আসল রহস্য, আধ্যাত্মিকতা ও তৃপ্তি উপলব্ধি করা সম্ভব। রুকু অর্থ বিনয়ী হওয়া, সিজদা অর্থ আল্লাহর হুকুম মেনে চলা।
আল্লাহ প্রথমে রুকু (বিনয়) ও সিজদা (আনুগত্য) করার নির্দেশ দেন, তারপর ইবাদত ও নেক আমলের কথা বলেন। কিন্তু আমরা রুকু-সিজদার অর্থ না জেনে অনুবাদে বিভ্রান্ত হই। নামাজের আধ্যাত্মিক স্বাদ পেতে হলে রুকু-সিজদার প্রকৃত অর্থ জীবনে বাস্তবায়ন জরুরি।
সৃষ্টিজগতের মাধ্যমে আল্লাহর শিক্ষা
সূরা ফুরকানের ৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন: “তাদেরকে যখন বলা হয়, দয়াময়কে সেজদা করো (আনুগত্য করো), তখন তারা বলে, দয়াময় আবার কে?” সূরা আরাফের ২০৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন: “নিশ্চয়ই যারা তোমার পরওয়ারদিগারের সামনে রয়েছে, তারা তার ইবাদতে অহংকার করে না… এবং তাকেই সেজদা করে।”
সূরা হাজের ১৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন: “তোমরা কি দেখো না আল্লাহকে সেজদা করে যা কিছু আছে নভোমণ্ডলে, যা কিছু আছে ভূমণ্ডলে—সূর্য, চন্দ্র, তারকারাজি, পর্বত, বৃক্ষ, জীবজন্তু এবং অনেক মানুষ?” সকল সৃষ্টি আল্লাহর হুকুম মেনে চলে। কিন্তু মানুষ অর্থ না বুঝে নামাজ পড়ে বলে আধ্যাত্মিকতা পায় না।
নামাজের আধ্যাত্মিকতা vs. যান্ত্রিকতা
নামাজকে ভিক্ষার সাথে তুলনা করা যায়। ভিক্ষুক যেমন স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রার্থনা করে, তেমনি নামাজে আল্লাহর সামনে হৃদয় খুলে দেওয়া উচিত। কিন্তু আমরা নামাজকে অনুবাদের যান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিণত করেছি। সূরা ফাতিহার অর্থ বুঝে পড়লে নামাজের প্রকৃত স্বাদ পাওয়া যায়।
নামাজে সূরা ফাতিহা পড়ার সময় আমরা আল্লাহর প্রশংসা, তার কাছে সাহায্য চাই এবং সিরাতুল মুস্তাকিমের পথ প্রার্থনা করি। কিন্তু অর্থ না জেনে পড়লে এটি কেবল শব্দের পুনরাবৃত্তি হয়। আল্লাহর সাথে কথোপকথনের পরিবর্তে আমরা যান্ত্রিকতা করি।
দরুদ ও নামাজ‑পরবর্তী আমলে প্রচলিত ভুল
সূরা আহযাবের ৫৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ ও ফেরেশতারা নবীর প্রতি সালাত (সম্মান) প্রদান করেন এবং মুমিনদেরও তা করতে বলেন। কিন্তু আমরা উল্টো আল্লাহকে নির্দেশ দিই: “আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদ!” এটা আল্লাহর আদেশের বিপরীত। এছাড়া নবীর পরিবার‑পরিজন ও অন্যান্য নবীদের নাম জুড়ে দেওয়াও কুরআনবহির্ভূত।
নামাজ শেষে সালাম ফিরানোর পর অতিরিক্ত দোয়া, শাফায়াত চাওয়া এবং নবীর জন্য “মাকামে মাহমুদ” প্রার্থনা করা যুক্তিহীন। এটি মানুষের মনগড়া সংযোজন। আল্লাহর রাসূলের মর্যাদা আল্লাহই নির্ধারণ করবেন, আমাদের অনুরোধের ওপর নির্ভরশীল নয়।
নামাজের অর্থ ও আধ্যাত্মিকতা ফিরিয়ে আনতে হলে কুরআনের সরল ব্যাখ্যা অনুসরণ করুন। অনুবাদ বুঝে পড়ুন, রুকু-সিজদার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য গ্রহণ করুন, এবং বাড়তি রীতি-নীতির বোঝা ঝেড়ে ফেলুন। শুধু তখনই নামাজ আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম হবে।