সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহর জন্য, যিনি বিশ্বজগতের প্রতিপালক, পরম দয়ালু ও অসীম করুণাময়।
আজকের আলোচনার বিষয় হলো সালাত। এ বিষয়ে একাধিক পর্বে আলোচনার ইচ্ছা রাখি, কেননা একটি পর্বে এর গভীরতা সম্পূর্ণরূপে উপস্থাপন অসম্ভব।
আজকের পর্বে আমরা সালাতের প্রচলিত ব্যাখ্যাগুলোকে পরখ করে দেখব। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে লক্ষ কোটি মুসলিমকে কীভাবে বিভ্রান্তির ফাঁদে ফেলা হয়েছে, তা উদ্ঘাটন করা হবে। সালাত একদিকে আল্লাহপ্রাপ্তির শ্রেষ্ঠ মাধ্যম, অন্যদিকে ধর্মব্যবসার সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার।
পরবর্তী পর্বগুলিতে আমরা সালাতের প্রকৃত অর্থ, কুরআনবহির্ভূত শিরকী উপাদান সংযোজন, এবং হাদিস‑কুরআনের সম্পর্ক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। উল্লেখ্য, হাদিসকে “গাইর মাতলু” (অপাঠ্য ওহি) এবং কুরআনকে “মাতলু” (পাঠ্য ওহি) বলা হয়। কিন্তু সালাতের ক্ষেত্রে কীভাবে “গাইর মাতলু“র অনুপ্রবেশ ঘটেছে, তা বিশ্লেষণ করা হবে।
কুরআনের নির্দেশনা: সূরা নিসা ৪৩
সূরা নিসার ৪৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন:
“হে মুমিনগণ! নেশাগ্রস্ত অবস্থায় সালাতের নিকটেও যেও না, যতক্ষণ না তোমরা যা বলছো তা বুঝতে পারো।”
এটি অত্যন্ত সরল ও দ্ব্যর্থহীন বিধান—নেশার প্রভাব থাকলে সালাত আদায় নিষিদ্ধ।
হাদিসের বিতর্কিত বর্ণনা ও হযরত আলী (রা.)-এর চরিত্র হনন
মজার বিষয় হলো, এই আয়াতের প্রেক্ষাপটে কিছু হাদিসে হযরত আলী (রা.)-কে মদ্যপানকারী হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে! বর্ণনায় বলা হয়, তিনি মদ্যপ অবস্থায় সালাতে ভুল করে এক সূরার পরিবর্তে অন্য সূরা তিলাওয়াত করেছিলেন, যার পরিপ্রেক্ষিতে মদ হারামের আয়াত নাযিল হয়।
এসব বর্ণনা হযরত আলী (রা.)-এর মর্যাদার সাথে সাংঘর্ষিক। একদিকে তাঁকে “আল্লাহর রাসূলের প্রিয় ভাই ও জামাতা” বলা হয়, অন্যদিকে অপবাদ দেওয়া হয় যেন তিনি নিকৃষ্ট অপরাধী! সম্ভবত শিয়া-সুন্নি বিভাজনের যুগে পরস্পরবিরোধী গোষ্ঠীগুলোর মিথ্যা রচনাই এগুলোর উৎস।
সূরা মায়িদার ৫৫ নং আয়াতের ব্যাখ্যা ও বিতর্ক
সূরা মায়িদার ৫৫ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন:
“তোমাদের বন্ধু (ওলি) তো কেবল আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং মুমিনগণ—যারা সালাত প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত দেয় ও রুকু অবস্থায় বিনয় প্রকাশ করে।”
এ আয়াতের প্রচলিত অনুবাদে “রুকু” শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। তবে এখানে মূল আরবি শব্দ “রাকি‘উন” (راكعون) এসেছে, যা সাধারণত সালাতের রুকুকে নির্দেশ করে। কিন্তু কিছু ব্যাখ্যাকার দাবি করেন, এখানে “রুকু“র অর্থ শুধু দৈহিক ভঙ্গি নয়, বরং আধ্যাত্মিক বিনয় ও নম্রতা বোঝানো হয়েছে। তাদের যুক্তি হলো, আয়াতের প্রেক্ষাপটে মুমিনদের গুণাবলি বর্ণনা করা হয়েছে, যেমন: সালাত কায়েম, যাকাত প্রদান ও অন্তরের বিনম্রতা। এতে সালাতের রুকুর সাথে যাকাতের সরাসরি সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত নয়।
শিয়া মাযহাবের ব্যাখ্যা ও হযরত আলী (রা.)-এর ঘটনা
শিয়া বিশ্বাস অনুযায়ী, এ আয়াত হযরত আলী (রা.)-এর বিশেষ মর্যাদা প্রমাণ করে। তাদের বর্ণনায় বলা হয়:
- একদিন হযরত আলী (রা.) সালাতের রুকুতে থাকাকালীন এক ভিক্ষুক মসজিদে এসে সাহায্য চান।
- তিনি রুকু অবস্থাতেই আঙুলের ইশারায় নিজের আংটি ভিক্ষুককে দান করেন।
- এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই এ আয়াত নাজিল হয় এবং আলী (রা.)-কে “ওলি” হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
এ ব্যাখ্যার সমালোচনা:
১. ভাষাগত অসঙ্গতি: আয়াতে “রাকি‘উন” (রুকুকারী) শব্দটি বহুবচনে ব্যবহৃত হয়েছে, যা কোনো ব্যক্তি বিশেষের ঘটনার সাথে সাংঘর্ষিক।
২. হাদিসের সনদগত দুর্বলতা: এ ঘটনার বর্ণনা শুধুমাত্র শিয়া সূত্রে পাওয়া যায়, যা সুন্নি হাদিসগ্রন্থে গৃহীত হয়নি।
৩. বাস্তবিক অসামঞ্জস্য: রুকু অবস্থায় হাতের আংটি খুলে দেয়া বা ইশারা করা সালাতের নিয়ম ও মনোযোগের পরিপন্থী।পরস্পরবিরোধী হাদিসের উদাহরণ
অন্যদিকে, কিছু হাদিসে হযরত আলী (রা.)-এর নামাজের সময় অলৌকিক ঘটনা বর্ণিত হয়েছে:
- “তিনি নামাজে এত মগ্ন থাকতেন যে, তাঁর পায়ে তীর বিদ্ধ হলে তিনি টেরও পেতেন না।“
এ বর্ণনা পূর্বোক্ত শিয়া বর্ণনার সাথে সাংঘর্ষিক। কারণ, নামাজে এত গভীর ধ্যানমগ্ন ব্যক্তি কীভাবে রুকু অবস্থায় আংটি দান করতে পারেন?
সেক্টেরিয়ানিজম ও চরম্পন্থী দৃষ্টিভঙ্গির বিপদ
এ ধরনের বিতর্কিত ব্যাখ্যার মূল উদ্দেশ্য হলো হযরত আলী (রা.)-কে অতিমানবীয় মর্যাদা দেয়া বা খারিজ করা। এতে দুই বিপদ দেখা যায়:
১. অতিউচ্চারণ: একদল তাঁকে আল্লাহ ও রাসূলের সমকক্ষ মনে করে, যা শির্কের দিকে নিয়ে যায়।
২. অবমূল্যায়ন: অন্যদল তাঁকে সাধারণ মানুষের চেয়েও নিচু স্তরে স্থান দেয়, যা ইসলামের নবীর পরিবার ও সাহাবিদের প্রতি অসম্মান।
কুরআন‑সেন্ট্রিক দৃষ্টিভঙ্গির গুরুত্ব
কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থে আয়াতের অর্থ বিকৃতি ঠেকাতে কুরআনকেই প্রাথমিক উৎস হিসেবে গ্রহণ জরুরি। সূরা মায়িদার ৫৫ নং আয়াতের মূল বার্তা হলো:
- আল্লাহ, রাসূল ও ন্যায়নিষ্ঠ মুমিনরাই মুসলিমদের প্রকৃত মিত্র।
- মুমিনের বৈশিষ্ট্য হলো সালাত, যাকাত ও আত্মসমর্পণ।
- কোনো ব্যক্তিবিশেষকে “ওলি” হিসেবে চিহ্নিত করা এ আয়াতের উদ্দেশ্য নয়।
আয়াতের প্রকৃত শিক্ষা: সালাতের জন্য সচেতনতা
আল্লাহর নির্দেশের মূল বার্তা হলো:
১. জ্ঞান ও বোধের সাথে সালাত আদায়:
- সালাতের প্রতিটি শব্দের অর্থ বুঝে, আল্লাহর সামনে দাঁড়ানোর গুরুত্ব অনুভব করতে হবে।
- নেশাগ্রস্ত ব্যক্তির মতো অজ্ঞানতায় বা গাফিলতিতে সালাত আদায় করলে তা অর্থহীন।
২. আধ্যাত্মিক উদাহরণ:
- “নেশা” শুধু মদপান নয়, যেকোনো আত্মিক অন্ধত্ব (যেমন: অহংকার, অনুরক্তি, গাফিলতি) কে নির্দেশ করে।
- নামাজে দৈহিক ভঙ্গি (রুকু-সিজদা) থাকলেও যদি অন্তরে আল্লাহর উপস্থিতি অনুভূত না হয়, তা “নেশাগ্রস্ত” অবস্থার সমান।
৩. জীবনের প্রতিশ্রুতি:
- সালাত হলো আল্লাহর সাথে চুক্তি renewal—জীবনের প্রতিটি কাজে তাঁর নির্দেশ মেনে চলার অঙ্গীকার।
- এ অঙ্গীকার রাখতে হলে সালাতের অর্থ, উদ্দেশ্য ও দায়িত্ববোধ স্পষ্টভাবে জানা জরুরি।
হাদিস
২ প্রকার হাদিসের কথা শুধু মহান আল্লাহ বলেছেন। একটা হচ্ছে আহসান আল হাদিস মানে পবিত্র কুরআন। আরেকটা হচ্ছে এই আহসান আল হাদিস বাদে যত হাদিস আছে, সবগুলোকে আল্লাহ বলেছেন লাউয়াল হাদিস। একজন মানুষকে যদি এই হাদিসের অর্থটা করা না হতো, তাহলে যে কোন সাধারণ মুসলিমই বুঝতে পারতো যে, আল্লাহ কুরআনে এই হাদিস শব্দটা ২ অর্থে ব্যবহার করেছেন। একটা আল্লাহর বাণী অর্থে, আরেকটা আল্লাহর বাণীর বাদে পৃথিবীর যত কিছু আছে মানুষের বানোয়াট লাহওয়াল হাদিস।
সুন্নত শব্দের অপপ্রয়োগ
কিন্তু খুব কুটেক অনুসরণ করে, খুব চালাকি করে, খুব সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা করে, এই হাদিসের প্রত্যেক জায়গায় দেখবেন যে, কোথাও হাদিসের ডাইরেক্ট অর্থ নাই। সবখানেই এর অর্থ বাণী/কথা দিয়ে বিকৃত করে। আমাদের ফোকাসটা কে সরিয়ে নেয়া হয়েছে হাসান আল হাদিসে আল্লাহু আলাইসালামের দুটো মৌলিক পার্থক্য থেকে।
ঠিক আরো একটা শব্দ হচ্ছে সুন্নাত। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ সুন্নত শব্দটা ব্যবহার করেছেন তা নিজের জন্য। আল্লাহ অনেকবার বলেছেন যে, আমার সুন্নতের কোনো পরিবর্তন নাই। সুন্নত শব্দের অর্থ কি আইন বা বিধান। কিন্তু আমরা নিজেরাই নিজেদেরকে সুন্নি বানিয়ে ফেলেছি। মানে আল্লাহ যে শব্দটা নিজের জন্য প্রয়োগ করেছেন, সেটাকে আমরা নিজের নিজেদের জন্য ব্যবহার করা শুরু করে দিয়েছি। তাও কতটা হাস্যকর যে, চিন্তা করুন।
আমরা জানি যে, আরবি কোন শব্দের সাথে ইযুক্ত করলেই প্রত্যায় যুক্ত করলে, সেটা আমার ক্ষেত্রে বিবেচ্য হয়ে যায়। যেমন রব মানে প্রতিপালক, রব্বী মানে আমার প্রতিপালক। আমরা প্রায়ই বলি “রব্বেদিয়ালমা” মানে “রব্বী কে হে আমার রব”। ঠিক তেমনি সুন্নি মানে কি “আমার সুন্নত”? তাহলে আমরা এই পৃথিবীতে যারা সুন্নী আছে, এর অর্থটা আসলে কি দাঁড়ায়? “আমার সুন্নত”? আপনি কি শিয়া না সুন্নি? না ভাই আমি শিয়ানা, আমি সুন্নি মানে কি? এর অর্থ হচ্ছে আমি আমার সুন্নত! কি হাস্যকর একটা ব্যাপার!
সারা পৃথিবীতে কোটি কোটি মুসলিম বলতেছে যে, “আপনি কোন মাযহাবের?” “আমি হচ্ছি আমার সুন্নত মাযহাবের”। মানে সুন্নত কি কোনো “আমার সুন্নত” হয়? সুন্নত হবে আল্লাহর সুন্নত। এইভাবে খুব হাস্যকরভাবে এর কোনো প্রকৃত অর্থ না দিয়ে, এর তাপসির তরজমা ব্যাখ্যা এমনভাবে করা হয়েছে, যাতে মানুষের ফোকাসটা ঘুরে যায় যে, আল্লাহ যে নিজের জন্য এই সুন্নত শব্দটা ইউজ করেছেন, সেটা যেন মানুষের ব্রেনেয়ার না ঢোকে।
নামাজ ও সালাতের পার্থক্য
কুরআনের শব্দার্থিক অস্পষ্টতা ও সমাধান
কুরআনের কিছু পরিভাষা (যেমন: রুকু, সিজদা, যাকাত) শাব্দিক অনুবাদ না করে সরাসরি আরবি শব্দ ব্যবহারের ফলে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়:
যাকাত (زكاة): শুধু অর্থদান নয়, এটি আত্মশুদ্ধি ও সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধের প্রতীক।
অর্থ করা হয়নি কোথায়? অর্থ করা হয়নি রুকুর ক্ষেত্রে, অর্থ করা হয়নি সিজদার ক্ষেত্রে, অর্থ করা হয়নি যাকাতের ক্ষেত্রে। এ কারণেই আমরা সবচেয়ে বেশি বিভ্রান্তের মধ্যে পড়ে গিয়েছি। অর্থ করেছে এই সালাতের। সালাতের অর্থ করেছে কি নামাজ? এটা ফারসি শব্দ। দেখুন বাংলাতেও প্রচলিত, ইংরেজিতে এর অর্থ হয় প্রেয়ার। এবং আমরা এটাও জানি যে, যত দোয়া করা হয়, হাদিসে ব্যতীতরাই বলেছেন যে, হাদিসের মধ্যে আছে যত দোয়া আল্লাহর কাছে করা হয়, তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ দোয়াই হচ্ছে নামাজ বা প্রার্থনা।
রুকু (رُكُوع): শাব্দিক অর্থ “নত হওয়া”। সালাতে এটি দৈহিক ভঙ্গি, কিন্তু আধ্যাত্মিক অর্থে আল্লাহর সামনে বিনয় প্রকাশ।
বাংলায় যদি আমরা একে প্রার্থনা বলি, ইংরেজিতে এটা কি বলা হয় প্রেয়ার। আর সংস্কৃতিতে কে বলা হয় উপাসনা বা পূজা। ইংরেজিগণ বলেন প্রেয়ার, হিন্দুরা বলে পূজা করি, আর আমরা বলি নামাজ পড়ি। যদিও পবিত্র কুরআনে আপনি কোথাও “ইকরা সালাত” পাবেন না। আপনি সব খানে পাবেন “আকিম মুস সালাত”। এবং কুরআনের প্রথম আয়াত টা যেটা নাযিল হয়েছে, সেটাই ছিল কি? “ইক্রাবিস মিরব্বি কাল্লাজি খালাখ”—পড়ো তোমার প্রভুর নামে। তার মানে আল্লাহ “ইকরা” শব্দ টার অর্থ জানেন। আল্লাহ নামাজ পড়ার অর্থ যদি বোঝাতেন, তাহলে “ইকরা সালাত“ই বলতেন। কিন্তু আল্লাহ পবিত্র কুরআনে কোথাও “ইকরা সালাত” বলেননি, বলেছেন “আকীম সালাত”।
প্রার্থনা ও কর্মের সমন্বয়
তারপরও আমরা সে হাদিস ব্যতীত তাদের অর্থটাই ধরে নেই। আমরা কি বলি? আমরা বলি নামাজ পড়ি। পবিত্র কুরআনে কোথাও আপনি এই “ইখড়ার সালাত” পাবেন না, আপনি পাবেন “আকিম মুস সালাত”। যার অর্থ হচ্ছে এই যে, প্রার্থনা এর উপরে আকিম থাকা, প্রতিষ্ঠিত থাকা। অর্থাৎ আমি আমার সেই প্রার্থনায় আমি যা বলব, যা চাইবো, ঠিক সেই লক্ষ্যেই আমার প্রতিদিনের জীবন পরিচালনা করতে হবে। আমার জীবনে সেই কথাগুলোকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, সেই সাধনায় রত থাকতে হবে।
পৃথিবীর যেকোনো বিদেশী ভাষা বা শব্দের অর্থ সঠিক ও সার্বজনীনভাবে জানা-বোঝা থাকলে হাজার হাজার বিদেশি শব্দ আসুক বা যাক, তাতে কারো কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু জানা নেই, বোঝা নেই বলেই আমরা বলছি নামাজ পড়ি। মানুষ কেন পড়ে? আপনি কি নিজেকে কখনো প্রশ্ন করে দেখেছেন? মানুষ পড়ে কি? শেখার জন্য। শেখা হয়ে গেলে তার আর পড়া আর প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজন হয় কি? সেটা করার।
অর্থ না বুঝে প্রার্থনার পরিণতি
একটা উদাহরণ দিচ্ছি: ধরুন একজন ডাক্তারি পড়ে, একজন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে। হয়তো তার সেই পোস্টটা ৩ বছর বা ৪ বছর বা ৫ বছরের। তো সে একটা মানুষ, সে ৪ বা ৫ বছর ডাক্তারি পড়ল। সে কি সারাজীবন ডাক্তারি পড়তেই থাকবে মেডিকেলে ইউনিভার্সিটিতে? না। সে ৪ বা ৫ বছর পড়বে, শেখা হয়ে গেলে, তারপর সারা জীবন বাকি জীবন সেই এই লব্ধ জ্ঞান প্রয়োগ করবে।
সুতরাং আমরা বুঝলাম যে, মানুষ মানুষ পড়ে শেখার জন্য। শেখা হয়ে গেলে পড়ার আর প্রয়োজন হয় না, প্রয়োজন হয় যা পড়েছে সেই লব্ধ জ্ঞান বাস্তবায়ন করার, প্রতিষ্ঠা করার। এজন্য গণ্ডমূর্খ গণ কখনো বলে না যে, “প্রার্থনা করি”, “গোসল পরী” বা “পায়খানা-প্রসাব পরী”।
তাছাড়া, মহান আল্লাহকে হাজির‑নাজির জেনে তার কাছে যে প্রার্থনা করি, সেই প্রার্থনার সাথে দৈনন্দিন কাজকর্মের মিল/সমর্থন/সহযোগিতা না থাকলে সেই প্রার্থনা গৃহীত হওয়ার বিন্দুমাত্র নিশ্চয়তা থাকে না। যেমন, আপনি যদি আপনার এলাকার চেয়ারম্যান বা এমপি সাহেবের কাছে কোন কিছু প্রার্থনা করেন, কোন কিছু চান। যেমন ধরুন আপনি যে গিয়ে বললেন যে, “চেয়ারম্যান সাহেব বা এমপি সাহেব, আমার একটা টিউবওয়েল দরকার। আমি আপনার দলের নীতি-আদর্শ সব মেনে চলি, আমি আপনার খুবই বাধ্যগত একজন মানুষ, একজন কর্মী, এবং আপনি আমার খুব প্রিয় অভিভাবক”।
কিন্তু সেই এমপি সাহেব পরে খোঁজ নিয়ে জানলেন যে, আপনি আসলে বিরোধী দলের লোক, এবং বিরোধী দলের মিছিল‑মিটিংয়ে আপনি সব সময় ব্যয় করেন, এবং এমপি সাহেবের দলের কোন নীতি-আদর্শ কিছুই আপনি আপনার প্রাকটিক্যাল লাইফে বাস্তবায়ন করেন না। এই কথা যদি এমপি সাহেব জানতে পারে, আপনাকে কখনো কি আপনি যত হাজারবারই তার কাছে বাড়ি বাড়ি গিয়ে যত ধরণা ধরেন, যতই তার কাছে কাকুতি-মিনতি প্রার্থনা করেন, আপনার সেই প্রার্থনাকে তিনি কবুল করবেন?
কুরআনের আয়াতের ভুল প্রয়োগ
ঠিক একইভাবে, আল্লাহ আপনাকে যেই নির্দেশ দিয়েছেন, আদেশ দিয়েছেন, সেগুলো যদি আপনি আপনার বাস্তব জীবনে প্রয়োগ না করেন, আপনি যদি দিনের মধ্যে পাঁচবার, দশবার, কেন ৫০ ওয়াক্ত পঞ্চাশবারও যদি আপনি তার কাছে প্রার্থনা করেন, কাকুতি-মিনতি করেন, আপনার সেই প্রার্থনা-দোয়া কি কোনদিনও কবুল হবে আল্লাহর কাছে? সেই এমপি সাহেবের কাছে যাওয়া সেই বিরোধী দলের সেই কর্মীর মতো। আপনি হাজার‑কোটি বার দিনের মধ্যে একশো বার প্রার্থনা বা আকুতি-মিনতি করতে পারেন, কিন্তু তার ১ পার্সেন্টেও গৃহীত হবে না। এটা ১০ বছরের বাচ্চাও বুঝতে পারে।
আরেকটা উদাহরণ দিচ্ছি: ধরুন আপনি কোন জজ বা বিচারকের কাছে কোন কিছু প্রার্থনা করলেন বা কোন ক্ষমা চাইলেন। কোন অন্যায় করে। সেই জজ বা বিচারক আপনাকে ক্ষমা করতে পারেন বটে, কিন্তু আপনি যে বিচারকের কাছে প্রার্থনা করলেন, সেই জজের কাছে যেই কাকুতি-মিনতি করে যা বললেন, তার বিষয়বস্তুটি আসলে কি? কি কি বললেন, তা তো আপনাকে অন্তত ঠিকঠাক বলতে হবে। এবং বিচারক ও আপনার উপর যে যে শর্ত দিয়েছে, তাও নিখুঁতভাবে আপনার বুঝতেও হবে। ইউরোর অনার বা জজ সাহেব সেই নীতি-আদর্শ‑রুলস‑রিলেশন অনুযায়ী আপনার সেই চাওয়া বা কাকুতি-মিনতি বা প্রার্থনা মঞ্জুর করতে পারেন।
সূরা ফাতিহার গুরুত্ব
এখন আমরা প্রার্থনা বা নামাজে কি চাইলাম, কি ওয়াদা করলাম, কি বললাম, হৃদয়ের চাওয়া গুলো ঠিক ঠিক আল্লাহকে হাজির‑নাজির জেনে বর্ণনা করতে পারলাম কিনা? যে আয়াত গুলো তেলাওয়াত করলাম, তাতে আমার অভাব‑অভিযোগ গুলি লিখিত আছে কিনা? তারপর কি কি শর্তের অধীনে আমাকে চলতে হবে, সেই বিধিনিষেধগুলো আমি বুঝতে পারলাম কিনা? তার বিন্দু-বিসর্গ পর্যন্ত যদি আমার জানা না থাকে, বোঝা না থাকে, তাহলে তা আমার পক্ষে আকিম করা/প্রতিষ্ঠা করা ১০০০০০ বছর নামাজ বা প্রার্থনা করলেও, প্রতিদিন ৫০ ওয়াক্ত করেও নামাজ বা প্রার্থনা করলেও, সেটা কোনদিনই সম্ভব নয়।
নামাজে আয়াত পাঠের সমালোচনা
সেই ব্যক্তি মনের অজান্তে আল্লাহকে হাজির‑নাঞ্জিত জেনে তার কাছে বারবার প্রার্থনা করবে, বারবার ক্ষমা চাইবে, বারবার ওয়াদা করবে, বারবার ওয়াদা ভঙ্গ করবে। এটা খুব স্বাভাবিক একটা বিষয়। অর্থাৎ নেশাখোরের মতই, মাতালের মতই, সে এই নামাজ বা প্রার্থনা দিনের পর দিন করতেই থাকবে, করতেই থাকবে।
আর এ কারণেই আমরা বাস্তবে দেখি যে, নামাজের শেষে, হজের শেষে ব্যক্তি আগে যেমন অপকর্ম, অন্যায়, অত্যাচার, যা পাপ যা করতো, তা করতেই থাকে। তার অন্যায়-অশ্লীল‑কাছ থেকে পাপ থেকে জুলুম থেকে, এই নামাজ‑এই প্রার্থনা তাকে ১ ইঞ্চিও সরাতে পারে না। সমগ্র মুসলিম বিশ্বের অধঃপতনের এটাই হচ্ছে মূল কারণ, এটাই হচ্ছে প্রধান কারণ।
উপসংহার
অতএব, সে যতই নামাজ পড়ে, মনের অজান্তে ততই তার পাপ বৃদ্ধি করে, ততই সে মোনাফেকের দলভুক্ত হয়। আর এদের সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন পাতায় পাতায়। সূরা নিসার ১৩৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন: “যারা ঈমান আনে অতঃপর কুফরি করে, আবার ঈমান আনে, আবার কুফরি করে, অতঃপর তাদের কুফরিতে এরূপ বাড়তেই থাকে। আল্লাহ তাদের কিছুতেই ক্ষমা করবেন না, হেদায়েতও করবেন না”।
সূরা বাকারার ২৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন: “যারা আল্লাহর সঙ্গে ওয়াদা করে প্রতিশ্রুতি করে এবং ওয়াদা ও প্রতিশ্রুতি করার পর তা ভঙ্গ করে, যে সম্পর্ক অক্ষম রাখতে আল্লাহ আদেশ দিয়েছেন তা ভঙ্গ করে, এবং দুনিয়ার বুকে অশান্তি ও গ্লানি সৃষ্টি করে বেড়ায়—তারাই ক্ষতিগ্রস্ত”।