নবী রাসুল পীর দরবেশ ও আমার নামাজ !

নামাজ সালাত

অভিশপ্ত শয়তান থেকে মহান আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাই। সকল প্রশংসা সমগ্র বিশ্বের প্রতিপালক মহান আল্লাহর জন্য, যিনি পরম দয়ালু, অসীম দয়াময়। আমরা আছি সালাত ও নামাজ সিরিজে। মহান আল্লাহ যুগে যুগে অসংখ্য আসমানী কিতাব প্রেরণ করেছিলেন মানবজাতির হেদায়েত ও রহমতের জন্য। এবং যে ইবলিশের ধোঁকায় মানুষ জান্নাত থেকে বিতাড়িত হয়েছিল, সেই জান্নাতে আবার কিভাবে সে পৌঁছাতে পারবে? সেই অসীম আনন্দ উপভোগের জীবনে সে লাভ করে ধন্য হতে পারবে সেই পথ, সেই সিরাতুল মুস্তাকিমের পথ দেখানোর জন্য।

মহান আল্লাহ যুগে যুগে আসমানে কিতাবের মাধ্যমে মানুষকেহেদায়েতের সেই পথ দেখিয়েছেন, কিন্তু মানুষ চিরকালই এই আসমানী কিতাবকে অবহেলা করে ছুড়ে ফেলে মানবরচিত লাহুয়াল হাদিসের দিকে ঝুঁকেছে। ইহুদিদের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল; তাওরাতকে ছেড়ে দিয়ে তারা তালমুদ,মিসনা,মিদ্রাস,জোহার,সিদ্দুর,নবীইম,কেতুবীম,গেমারা ধরেছে। খ্রিস্টানরা রোমান মিছাল,লিতুরগি,ছুম্মা থিলোযিকা,কনফেশনস,ইমিটেশন জি ঈসা,কানুন ল, ফিলোকালিয়া ধরেছে। আর বলা হয় যে বেদ নাকি আসমানী কিতাব, সেই ক্ষেত্রেও দেখা যায় যে বেদ এর সাথে তারা মহাভারত, রামায়ণ,পুরান, উপনিষদ,মনুসংহিতা,যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতি,ভগবদ্গীতা,তন্ত্রগ্রন্থ এসবের মধ্যে ডুবে আছে। তো সর্বশেষ যে আসমানী কিতাব, সেই পবিত্র কুরআনকেও আমরা পরিত্যাজ্য ঘোষণা করে আমরা লাহুআল হাদিসের কিতাব বুখারি,তিরমিজি,নাসাই,মাজাহ,কাসির,তাবারি,হেদায়া,বেদায়া,মাবসুত,উম,কাফি,ইস্তিবসার,বালাগা,মাকাসিব,উসকা,ইতিকাদা,কুম্মি,আয়াশি.উলিয়াত.রিসালাত আমালিয়াত এ পরে আছি। তো এই কুরআন এই লাহুয়াল হাদিসের কাছে একটা জায়গায় হেরে যায়, সেটা হচ্ছে নামাজ।

যারা লাহুআল হাদিসের অনুসারী, তারা চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলে যে, তোমরা বলো তোমাদের কোরআন নাকি পরিপূর্ণ জীবন বিধান, এতে নাকি সবকিছু আছে। একটা মানুষের জন্য যা প্রয়োজন, তার সবকিছুই এই কোরআনে আছে। তো যদি থাকে, তাহলে আমাদের কোরআন থেকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ বের করে দেখাও। তো এই একটা জায়গায় হেরে যায় কোরআন, জিতে যায় হাদিস। তো আমরা এই সিরিজটা শুরু করেছিলাম কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা হিসাবে। মানে, এই হাদিস দিয়ে আমরা প্রমাণ করব যে, এই নামাজটা আসলে প্রকৃত অর্থে সালাত কিনা, এবং এই নামাজ আসলে কয় ওয়াক্ত।

আমরা দুটো গ্রন্থের সহায়তা নেব: একটা হচ্ছে আর‑রাহিকুল মাখতুম, আরেকটা হচ্ছে মুখতাসারুস সিরাত। ইবনে হাজার আসকালানী রহমাতুল্লাহ বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সাহাবায়ে কেরাম মিরাজের ঘটনার আগেই নামাজ আদায় করতেন। তবে এ ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, সূর্য উদয় হওয়ার আগে ও অস্ত যাওয়ার আগে একেকটি নামাজ ফরজ ছিল।বারা ইবনে আজেব রহমাতুল্লাহি আলাইহি ও ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকেও এ ধরনের হাদিস বর্ণিত আছে। ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণিত হাদিসে রয়েছে, এই নামাজ ছিল প্রথম দিকে ফরজের অন্তর্ভুক্ত (মুখতাসারুস সিরাত, শেখ আব্দুল্লাহ, পৃষ্ঠা ৮৮)।

ইবনে হিশাম রহমাতুল্লাহি আলাইহি বর্ণনা করেছেন, ইসলামের সূচনাকালে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম নামাজের সময় পাহাড়ে চলে যেতেন এবং গোপনে নামাজ আদায় করতেন। একবার আবু তালেব রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে নামাজ পড়তে দেখে ফেলেন। তিনি এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন, তাকে জানানোর পর তিনি বলেন, এই অভ্যাস অব্যাহত রাখো (ইবনে হিশাম, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৪৭)। আর রাহিকুল মাখতুম গ্রন্থে এই দুটো বইতে আমরা দেখলাম যে, আল্লাহর রাসূল মিরাজের আগে দুই ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন: একটা হচ্ছে সূর্য উদয়ের আগে, আরেকটা হচ্ছে সূর্য অস্ত যাওয়ার আগে। এবং এ সম্পর্কিত হাদিস বর্ণনা করেছেন ইবনে আব্বাস এবং বাররাহ ইবনে আজেব। এখনো প্রশ্ন হচ্ছে যে, হাদিসেই বলছে যে আল্লাহর রাসূল দুই ওয়াক্ত নামাজ পড়ছেন ৬১৯ সাল, মিরাজে যাওয়ার আগ পর্যন্ত।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, দুই ওয়াক্ত কেন? এবং এই হাদিসেই আছে যে, পূর্ববর্তী নবীরাও এই দুই ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। দুই ওয়াক্ত কেন? এটা বুঝতে হলে আমাদের একটু বাস্তবতার নিরিখে চিন্তা করতে হবে। সেটা হচ্ছে যে, তখন কিন্তু এই বিদ্যুৎ এভেইলেবল ছিল না, মিল‑ইন্ডাস্ট্রি, ফ্যাক্টরি এতটা ছিল না। মানুষ সারাদিন কর্মব্যস্ত থাকতো, ফ্রি হতো সন্ধ্যায় অথবা সকালে। যারা কৃষি ক্ষেতে কাজ‑কর্ম করতো, তারা খুব সকালেই হয়তো বেরিয়ে যেত। আর যারা ব্যবসা-বাণিজ্য করতো, তারা সকালে একটু দেরি করে বের হলেও হয়তো সমস্যা হতো না। এই দুইটা সময়েই নামাজটা হতো। নামাজটার আসলে কি দরকার? দেখুন, আল্লাহর রাসূলের কাছে যে ওহী আসতো ২৩ বছরে প্রায় সোয়া ছয় হাজার আয়াত। এর মধ্যে অসংখ্য আয়াত আছে যে খুব ছোট ছোট, যেমন আলিফ‑লাম‑মীম, আলিফ‑লাম‑রা, কুলহু আল্লাহু আহাদ, আল্লাহুস সামাদ।

এরকম তিন‑চার‑পাঁচশ আয়াত আপনি পাবেন খুব ছোট ছোট। প্রতিবছর গড়ে ২০০ থেকে ২৫০ আয়াত নাযিল হতো। এই নামাজে যখন মানুষ শুনতো, আল্লাহর রাসূলের মুখে শুনতে শুনতে, শুনতে শুনতে –সকাল‑বিকাল সকাল‑বিকাল মানুষের মুখস্থ হয়ে যেত। কিন্তু মানুষ কেন এই ধর্মটার প্রতি আকৃষ্ট হতো? এবং মানুষ কি করে বুঝতো যে, আল্লাহর রাসূল এখন যে কথাগুলো বলবেন, সেগুলো তার নিজের কথা নয়, সেগুলো আল্লাহরই বাণী? তিনি প্রথমেই বলতেন: رَبِّ أَعُوذُ بِكَ مِنْ هَمَزَاتِ الشَّيَاطِينِ بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ। যখনই তিনি বলতেন, তখন সবাই বুঝে ফেলত যে এখন তিনি যা বলবেন, সেগুলো তার নিজের কোনো কথা নয়, এগুলো আল্লাহর বাণী।

তিনি এখন আমাদের বলবেন। তিনি কি ধরনের কথা বলতেন? হয়তো তিনি সূরা তাকাসুর বলতেন: “প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা, ধন-সম্পদ বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা তোমাদের মজিয়ে রেখেছে, যতক্ষণ না তোমরা কবরসমূহে উপস্থিত হচ্ছ। এটা সংগত নয়, তোমরা শীঘ্রই এটা জানতে পারবে। আবার বলি, এটা সংগত নয়, তোমরা শীঘ্রই তা জানতে পারবে। সাবধান! তোমাদের নিশ্চিত জ্ঞান থাকলে অবশ্যই তোমরা মোহাচ্ছন্ন হতে না। তোমরা অবশ্যই জাহান্নাম দেখবে। আবার বলি, তোমরা তো ওটা দেখবে এই চাক্ষুষ প্রত্যয়। নিজের চোখে। এরপর অবশ্যই সেদিন তোমাদের সুখ‑সম্পদ ও নেয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।” হয়তো আরেকদিন আল্লাহর রাসূলের মুখে তারা শুনতো সূরা লাইল: “শপথ রাতের, যখন ওটা আচ্ছন্ন করে; শপথ দিনের, যখন ওটা উদ্ভাসিত হয়; এবং শপথ নর ও নারীর, যা তিনি সৃষ্টি করেছেন। অবশ্যই তোমাদের চেষ্টা-সাধনা বিভিন্নমুখী।

অতএব, যে দান করে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ও আল্লাহকে ভয় করে এবং যা উত্তম তাকে সত্য বলে মনে করে, অচিরেই আমি তার জন্য সুখের বিষয়ে জান্নাত সহজ করে দেব। অন্যদিকে, যে ব্যক্তি কৃপণতা করে আর আল্লাহর প্রতি বেপরোয়া হয় এবং যা উত্তম তা প্রত্যাখ্যান করে, অচিরেই আমি তার জন্য সুগম করে দেব কঠোর পরিণামের পথ। এবং তার ধন-সম্পদ তার কোনো কাজেই আসবে না, যখন সে ধ্বংস হবে। আমার কাজ তো শুধু পথনির্দেশ করা। আর আমিই মালিক পরলোকের ও ইহলোকের। আমি তোমাদেরকে জাহান্নামের লেলিহান আগুন থেকে সতর্ক করে দিয়েছি। তাতে প্রবেশ করবে সেই যে নিতান্ত হতভাগা, যে সত্যকে অবিশ্বাস করে আর মুখ ফিরিয়ে নেয়। আর ওটা হতে রক্ষা পাবে আর তা থেকে দূরে রাখা হবে এমন ব্যক্তিকে, যে আল্লাহকে খুব বেশি ভয় করে; যে পবিত্রতা অর্জনের জন্য, আত্মশুদ্ধির জন্য নিজের সম্পদ, ধন-সম্পদ দান করে। এবং তার প্রতি কারো অনুগ্রহের প্রতিদান হিসেবে নয়, সে তো শুধু তার মহান রবের সন্তুষ্টি প্রত্যাশা করে।

আর সে অবশ্যই সন্তুষ্ট হয়ে আল্লাহর জান্নাতে প্রবেশ করবে।” হয়তো অন্যদিন আল্লাহর রাসূল বলছেন, “আমি তোমাদের মতই মানুষ, আমি জানিনা আমার সাথে আর তোমাদের সাথে আল্লাহ কি আচরণ‑কি ব্যবহার করেন।” হয়তো আরেকদিন বলছেন, “তোমরা যত কাজ করো, যত নেক আমল করো, হাশরের মাঠে সূরা আরাফের ৭‑৮ নম্বর আয়াত বলছেন: তোমাদের দুনিয়ায় করা নেক আর পাপ ওজন করা হবে। যার নেকের পাল্লা ভারী হবে, সে জান্নাতে যাবে; আর যার পাপের পাল্লা ভারী হবে, সে জাহান্নামে যাবে।” হয়তো আরেকদিন তার উপর যে নাযিলকৃত ঐশি বাণী এসেছিল, তা তিনি বলছেন: “হে মানুষেরা, তোমাদের মধ্যে আল্লাহর দৃষ্টিতে সেই ব্যক্তি সবচেয়ে বেশি সম্মানিত, যে সবচেয়ে বেশি মুত্তাকী।” [ সুরা হুযুরাত ৪৯:১৩]

তো মানুষ বুঝতে পারতো যে, আল্লাহর চোখে ধনী-গরীব, সাদা-কালো, গরীব‑দুঃখী, নারী-পুরুষ কারো কোনো ভেদাভেদ নেই। এটা এমন একটা ধর্ম, এখানে কোনো ব্রাহ্মণ‑ক্ষত্রিয়-বৈশ্য‑শূদ্র ভেদাভেদ নাই। এখানে সকল মানুষ সমান। এবং সেই মানুষদের মধ্যে যে সবচেয়ে বেশি মুত্তাকী, আল্লাহর দৃষ্টিতে সে সবচেয়ে বেশি সম্মানিত। এবং হাশরের মাঠে যারা মুত্তাকী হতে পারবে, তাদেরকে আল্লাহ স্পেশাল গেস্ট, বিশেষ অতিথি হিসেবে সেদিন আল্লাহ সম্মানিত করবেন। এটা এমন একটা ধর্ম, যে ধর্মে বলে সূরা বাকারার ১৭৭ নম্বর আয়াতে: “সম্পদের প্রতি ভালোবাসা সত্ত্বেও আল্লাহ ভালোবাসার্থে তোমরা তোমাদের অর্থসম্পদ দান করো অসহায়, এতিম, আত্মীয়-স্বজন ও গরীব‑দুঃখী, ভিখারী, মুসাফিরদের জন্য। তোমরা ধৈর্যশীল হও, তোমরা সত্যবাদী হও। তাহলে তোমরা হতে পারবে মুত্তাকী।”

এই ধর্মটাতে যারা মুত্তাকী হতে পারে, তাদেরকে সবচেয়ে বেশি প্রায়োরিটি দেয়া হয়, সবচেয়ে বেশি সম্মানিত করা হয়, সবচেয়ে বেশি আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন বলা হয়। এই ধর্মে ইনসাফ, ন্যায়বিচার, মানুষের প্রতি জুলুম না করার নির্দেশ দেয়। এত চমৎকার একটা ধর্ম, তখন মানুষ উদ্বেলিত হয়ে যায়, উল্লসিত হয়ে যায়। এবং সে আশেপাশের মানুষকে এসে বলে, “জানো, এক রাসূল এসেছে আমাদের কাছে। সে নিজের মুখ থেকে যা বলে, তা তার নিজের কোনো কথা নয়, সে আল্লাহর কথা বলে।

আর এই আল্লাহ এমন আল্লাহ, যে মানুষকে ইনসাফের নির্দেশ দেয়, মানুষকে সৎ কাজের নির্দেশ দেয়, এবং এর বিনিময়ে অনন্ত সুখের জান্নাত অফার করে।” সূরা নাহলের ৯০ নম্বর আয়াতে যেমনটা আছে। হয়তো আল্লাহর রাসূল একদিন মানুষকে শোনাতেন: “নিশ্চয়ই আল্লাহ ইনসাফ‑ন্যায়পরায়ণতা, মানুষের সাথে সুন্দর আচরণ ও আত্মীয়-স্বজনকে দানের নির্দেশ দেন। এবং তিনি নিষেধ করেন অশ্লীলতা, অসৎ কাজ ও বাড়াবাড়ি করতে। তিনি তোমাদেরকে উপদেশ দেন, যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ করো।” মানুষ এ ধরনের বাণী শুনে পাগলের মতো হয়ে যেত যে, এত চমৎকার একটা ধর্ম, যেই ধর্মে ধনী-গরীব কোনো ভেদাভেদ নেই। এবং এই ধর্মে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সবকিছু দান করে আত্মশুদ্ধির (তাসকিয়া নফসের) আদেশ দেন মহান আল্লাহ।

এই ধর্মে বলা হয়েছে সূরা আহযাবের ৩৫ নম্বর আয়াতে: “সে নারী হোক বা পুরুষ হোক, সে যদি মুমিন হয়, সত্যবাদী হয়, সে যদি ন্যায়পরায়ণ হয়, সে যদি ইনসাফকারী হয়, সে যদি ধৈর্যশীল হয়, তাহলে তার জন্য রয়েছে জান্নাত।” এখানে নারী-পুরুষের কোনো ভেদাভেদ নেই, গরীব‑ধনীরও কোনো ভেদাভেদ নেই। কী চমৎকার একটা ধর্ম! মানুষ পাগলের মতো এই ধর্মকে তখন আলিঙ্গন করতো। তো এই ধর্ম সম্পর্কে মানুষ কিভাবে জানতো? এই যে প্রথমেই বললাম, সেই সিরাত ইবনে হিশাম থেকে আর রাহিকুল মাখতুম থেকে যে সকাল আর বিকেল (মানে সন্ধ্যায়) আল্লাহর রাসূল উপস্থিত হতেন। দলে দলে মানুষ সেখানে সমবেত হতো। আর আল্লাহর রাসূল কোরআন থেকে তাদের শোনাতেন।

ওই সময়ে শুনতে শুনতে- যেহেতু অল্প কিছু মানুষ একসাথে হতো, তখন তাদের এই সোয়া ছয় হাজার আয়াত ছিল না। অল্প অল্প করে আয়াত নাযিল হতো। মানুষ সকালে শুনতো, বিকেলে শুনতো, পরদিন সকালে শুনতো, বিকালে শুনতো। শুনতে শুনতে মানুষের এই বাণীগুলো এত ভালো লাগতো , কী চমৎকার মানবতার একটা ধর্ম! মানুষ তার আশেপাশের মানুষকে বলতো, তার পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের সবকিছুর মধ্যে তারা একটা স্বপ্ন দেখতো যে, সব মানূষই এক, এই পৃথিবীটাই শান্তিময় বেহেশতের বাগান হয়ে যাবে, যদি মহান আল্লাহর আদেশ‑নিষেধগুলো মেনে চলতে পারি। আর কত চমৎকার একটা ধর্ম! এইভাবে সকাল আর বিকেলে শুনতে শুনতে মানুষের এই আয়াতগুলো মুখস্থ হয়ে যেত।

আর এইভাবেই যুগে যুগে আল্লাহর রাব্বুল আলামীনের যত নবী-রাসূল এসেছেন, মানুষকে এইভাবেই আল্লাহর বাণী শুনিয়েছিলেন। তাদের এই যে সাহাবী ২০০০, ৫০০০, ১০০০০, ২০০০০, ৫০০০০, এক লক্ষ, হাজার হাজার সাহাবী, এদের সবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে রাসূলদের পক্ষে কি এই আল্লাহর বাণী বাল্লিক করা (তাবলীগ করা) সম্ভব? কখনোই সম্ভব না। তার শত শত বছর লাগবে। যদি ২০,০০০ সাহাবীদের প্রত্যেকের ঘরে ঘরে গিয়ে শোনাতে হতো? তাছাড়া ধরুন আজকে নাযিল হলো ২০টা আয়াত, যা পৌঁছাতে মানুষের কাছে পৌঁছাতে হবে, তাবলীগ করতে হবে , তাহলে দু-চার‑পাঁচ বছর তো দূর হাজার বছরও তিনি পারবেন না।

এ কারণেই এই সকাল আর সন্ধ্যা। সকল নবীরা এই সময়টাতেই নামাজ পড়তেন অর্থাৎ এই সময়টাতেই তারা এই আল্লাহর বাণী মানুষকে পৌঁছে দিতেন। এবং আমরা হাদিসে শুনেছি যে, আল্লাহর রাসূল এমন দীর্ঘ নামাজ পড়তেন যে, তার পা ফুলে যেত। হয়তো তিনি প্রথম রাকাতে সূরা বাকারা, পরের রাকাতে সূরা আল ইমরান পড়তেন। এই দুই রাকাত নামাজের তিন ঘন্টা শুধু আল্লাহর বাণী তিনি বলতেন। রুকু-সেজদা করতে হয়তো বড়জোর পাঁচ মিনিট সময় লাগতো, আর দুই ঘন্টা ৫৫ মিনিটে তিনি আল্লাহর বাণী তেলাওয়াত করতেন। সূরা মুজাম্মিলে আমরা দেখি যে, তিনি ধীরে ধীরে স্পষ্টভাবে আল্লাহর বাণী তেলাওয়াত করতেন।

তো এই যে সৃষ্টির শুরু থেকেই দুই ওয়াক্ত যে নামাজে মানুষকে আল্লাহর ঐশি বাণী শোনানো, এই যে কনফারেন্স করা, এটা কিভাবে পাঁচ‑ছয়-সাত ওয়াক্ত হয়ে গেল? ইশরাক, চাশত, তাহাজ্জুদ, নফল…এর সাথে তারাবি, কুসুফ, খুসুফ, চাশত, আশুরা, জানাজা, শুকরিয়া, বৃষ্টির নামাজ, ভয়ের নামাজ, সাকরাতুল মৌতের নামাজ… মানে নামাজের কোনো সীমা-পরিসীমা নাই। মানে ১০-২০-৩০ ওয়াক্ত বানিয়ে ফেলেছে। কিন্তু এর মূল উদ্দেশ্য কি? আল্লাহর বাণী মানুষকে পৌঁছানো সেটা থেকেই বঞ্চিত করা হচ্ছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে, আমাদের তো আর সেই আল্লাহর নবীদের মতো মানুষের কাছে আমাদের বাণী পৌঁছাতে হবে না। আমরা নিজেরা কি করবো? নিজেরা কিভাবে নামাজ আদায় করব? তার উত্তর খুব সহজ। আমি প্রত্যেকটা পর্বতেই বলেছি যে, ফার্সিতে যে নামাজটা ব্যবহার করা হয়, এর অর্থ হচ্ছে প্রার্থনা করা, ভিক্ষা করা, মোনাজাত করা, দোয়া করা। সবচেয়ে বড় দোয়া হচ্ছে এই নামাজ।

তো আল্লাহর কাছে দাঁড়িয়ে আপনি আল্লাহর কাছে দোয়া করবেন, কাকুতি-মিনতি সহকারে, যেমনটা আল্লাহ কোরআনের পাতায় পাতায় বলেছেন। ইউসুফ নবী, ইব্রাহিম নবী, ইউনুস নবী, মুসা নবী, ঈসা নবী, আইয়ুব নবী… সবাই আল্লাহর কাছে এইভাবে নামাজ পড়তেন, এইভাবেই ভিক্ষা চাইতেন। সেই আইয়ুব নবী কত অসুখ, দুঃখ, কষ্টে ভুগে তিনি আল্লাহর কাছে এইভাবেই ভিক্ষা চেয়েছেন: “ওগো আল্লাহ, আমি আর পারছি না, আমি আর দুঃখ‑কষ্ট সইতে পারছি না। তুমি তো দয়ালুদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু।”

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সাথে সাথে তার সেই প্রার্থনা মঞ্জুর করেছেন। ইউনুস নবী বলেছিলেন: “ওগো আল্লাহ, আমি তো নিজের প্রতি জুলুম করেছি। আল্লাহ, তুমি ছাড়া আমার আর কে আছে?” সাথে সাথে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার সেই প্রার্থনা, তার ভিক্ষা যা তিনি চেয়েছেন, সেটা মঞ্জুর করেছেন। মুসা নবী একজনকে খুন করে, যিনি ফেরাউনের রাজপ্রাসাদে রাজপুত্রের মতো জীবন কাটিয়েছেন, ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে খুনের ফেরারি আসামী হয়ে দেশ থেকে পালিয়ে মাদিয়ান শহরে এসেছিলেন। তার পকেটে টাকা নাই, পয়সা নাই, দু মুঠো খাওয়ার ব্যবস্থা নাই, চাকরি নাই, বাকরি নাই, থাকার জায়গা নাই, ঘরবাড়ি কিচ্ছু নাই। অজানা-অচেনা এক শহরে এসে তিনি উপস্থিত হয়েছেন। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে, এমন নিঃস্ব, অসহায়, রিক্তশূন্য একজন মানুষ আল্লাহর কাছে ভিক্ষা চেয়েছেন: “ওগো আল্লাহ, তুমি আমাকে যেই নিয়ামত দাও, আমি তো তারই ভিখারী।” সাথে সাথে আল্লাহ তার সেই ভিক্ষা, সেই প্রার্থনা মঞ্জুর করেছেন।

তার বিয়ের ব্যবস্থা করেছেন, তার থাকার ব্যবস্থা করেছেন, তার চাকরির ব্যবস্থা করেছেন, তার ঘরের ব্যবস্থা করেছেন, তার খাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন, ব্যবস্থা করেছেন সবকিছুর। আল্লাহ সব চাহিদা মিটিয়ে দিয়েছেন। নবী-রাসূলদের জীবনের কাহিনী যদি আমরা পড়ি দেখবো, আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের যতগুলো নবী-রাসূলদের জীবনে বিপদ-আপদ এসেছে কে কোন সময় কিভাবে আল্লাহর কাছে ভিক্ষা চাইতো, প্রার্থনা করতো আল্লাহ তা কুরআনে বর্ণনা করেছেন। কোথাও সেই নবী হাত কোথায় বাঁধবে, পেটে না বুকে,নাভির উপরে না নিচে,আমিন জোরে না আস্তে এসব কোনো বিষয়েই আল্লাহ তায়ালা আলোচনা করেননি। তিনি মূল জিনিসগুলোর প্রতি, মূল কথাগুলোর প্রতি ফোকাস করেছেন।

আমরা সেইভাবে, সেই আবেগ‑অনুভূতি নিয়ে, মনের গহীন থেকে, অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে, হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা নিয়ে, ইমোশন দিয়ে আল্লাহর কাছে ওইভাবে মুসা নবীর মতো, ঈসা নবীর মতো, আইয়ুব নবীর মতো প্রার্থনা করবো। আল্লাহর কাছে ভিক্ষা চাইবো। আমার যা লাগে, আমার অভাব‑অনাটন, দুঃখ‑কষ্ট, বেদনা অনুযায়ী আমি সেইভাবে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করব। তবে প্রার্থনার শুরুতেই আমি যেটা করি, সেটা আপনাদের সাথে শেয়ার করি। প্রার্থনার শুরুতেই মনে রাখতে হবে যে, আমরা যা বলি সেটা যদি বুঝে না বলি, এই প্রার্থনা, এই ভিক্ষা কোনোদিনও মঞ্জুর হওয়ার কথা নয়। একজন ইংরেজ যদি বাংলা ভাষায় আপনার কাছে কোনো ভিক্ষা চায়, কোনো কিছু চায়, সে নিজেও বুঝে না কি বলে।

কখনোই তার সেই প্রার্থনা বা ভিক্ষা চাওয়া আপনার হৃদয় গলাতে পারবে না। কারণ সেই বাংলাটা তো তার নিজের ভাষায় না। সেই অন্তরের অন্তস্থল থেকে সেই ইমোশন তার কখনোই আসবে না। এজন্য আমি যেটা করি, প্রথমে সূরা ফাতিহা প্রথমেই বলি: “الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ” (ওগো আল্লাহ, সকল প্রশংসা তোমার, তুমি তো সমগ্র বিশ্বের প্রতিপালক)। “الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ” (তুমি তো পরম দয়ালু, দয়ার সাগর, অসীম দয়াময়)। মনের ভিতরে সেই বাংলাটা ওইভাবে নিয়ে আসি: “إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ” (আল্লাহ গো, আমি তো শুধু তোমারই গোলামী করি, তোমার দাসত্ব করি। তোমার যত আদেশ‑উপদেশ আছে, সমস্ত কিছুর একজন গোলাম। একজন চাকর, একজন দাস যেমন তার মনিবের সকল আদেশ‑নিষেধ মেনে চলে; না চললে তাকে সেই চাকরি থেকে তাড়িয়ে দেয়, ঘর থেকে বের করে দেয়, ঠিক তেমনি, আমি সেরকম দাস,তুমি সেই মনিব। তুমি তো আমার মনিব। তোমার সকল আদেশ‑উপদেশ আমি মেনে চলি।

আমি সুদ খাই না, আমি ঘুষ খাই না, আমি মানুষের উপর জুলুম করি না, গীবত করি না, মিথ্যা বলি না। আমি সামর্থ্য অনুযায়ী মানুষের উপকার করি, মানুষকে দান করি, আত্মীয়-স্বজন, অভাবী, প্রতিবেশী, তাদেরকে দেয়ার চেষ্টা করি। মানুষের উপর ইনসাফ করি, মানুষের সাথে সদয় আচরণ করি। এবং এগুলো আমি অব্যাহত রাখবো, আল্লাহ। কারণ আমি তোমার প্রকৃত গোলাম, প্রকৃত দাস হতে চাই।

আমি এখন তোমার কাছে সাহায্য চাই।” আল্লাহ কি সাহায্য জানো? এখন আমি যে তোমার দাস, তোমার গোলাম, সেই অধিকারে আল্লাহ, আমি তোমার কাছে “إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ” (তোমার কাছে সাহায্য চাই)। আল্লাহ কি সাহায্য জানো? “اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ” (তুমি আমাকে সহজ-সরল সঠিক পথ দেখাও। সিরাতুল মুস্তাকিম দেখাও, যেই পথে গেলে আমি জান্নাতে যেতে পারব। আমি জাহান্নামের কঠিন আগুনে যেতে চাই না)। “صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ” (সেই পথ, যেই পথে তোমার প্রিয় বান্দারা গিয়েছে, প্রিয় গোলামেরা, প্রিয় চাকরেরা, প্রিয় দাসেরা গিয়েছে)। “غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ” (সেই পথে নয় গো আল্লাহ, যেই পথে চললে তোমার গজব নাযিল হবে, তোমার অভিসম্পাত নাযিল হবে)। সেই পথটা কি? আমি তো জানি, আল্লাহ। সেই পথে চললে ঘুষ খেতে হয়, সুদ খেতে হয়, মানুষের উপর জুলুম করতে হয়, মানুষকে ঠকাতে হয়, খাদ্যে ভেজাল দিতে হয়, মানুষের সাথে খারাপ আচরণ করতে হয়, গীবত করতে হয়, মিথ্যা বলতে হয়।

এইরকম পথে আমি চলতে চাই না, আল্লাহ। এই পথে তো চলতে তুমি আমাকে কোরআনের পাতায় পাতায় নিষেধ করেছো। এই পথে চললে আমার উপর গজব নাযিল হবে, অভিসম্পাত নাযিল হবে। এই পথে আমি চলতে চাই না। সেই পথ থেকে তুমি আমাকে বাঁচাও, আল্লাহ। এইভাবে মনের আকুতি নিয়ে প্রথমে সূরা ফাতিহাটা পাঠ করি। তারপর কখনো সূরা বাকারার ২৮৬ নম্বর আয়াত: “رَبَّنَا لَا تُؤَاخِذْنَا إِن نَّسِينَا أَوْ أَخْطَأْنَا” (ওগো আমার রব, যদি আমি ভুলে যাই অথবা ভুল করি, তুমি আমাকে অপরাধী করো না)। “رَبَّنَا وَلَا تَحْمِلْ عَلَيْنَا إِصْرًا كَمَا حَمَلْتَهُ عَلَى الَّذِينَ مِن قَبْلِنَا” (ওগো আমার রব, আমাদের পূর্ববর্তীগণের উপর যে গুরু দায়িত্ব অর্পণ করেছিলে, আমাদের উপর তেমন গুরু দায়িত্ব অর্পণ করো না)। “رَبَّنَا وَلَا تُحَمِّلْنَا مَا لَا طَاقَةَ لَنَا بِهِ” (ওগো আমার প্রতিপালক, এমন ভার আমাদের উপর অর্পণ করো না, যা বহন করার শক্তি আমার নাই)। “وَاعْفُ عَنَّا وَاغْفِرْ لَنَا وَارْحَمْنَا” (আমার পাপগুলো মোচন করে দাও, আমাকে ক্ষমা করে দাও, আমার প্রতি তুমি দয়া করো)। “أَنتَ مَوْلَانَا فَانصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكَافِرِينَ” (তুমি তো আমার মাওলা, আমার অভিভাবক। সুতরাং বর্বরদের পথে আনতে আমাকে সাহায্য করো)। কখনো সূরা আল ইমরানের ৮‑৯ নম্বর আয়াত: “رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا” (ওগো আমার প্রতিপালক, সরল পথ (সিরাতুল মুস্তাকিম) পথ দেখানোর পর তুমি আমাকে সেই পথ থেকে আর বিচ্যুত করো না)। “وَهَبْ لَنَا مِن لَّدُنكَ رَحْمَةً” (তুমি আমাকে তোমার নিকট থেকে দয়া করো, করুণা দাও)। “إِنَّكَ أَنتَ الْوَهَّابُ” (তুমি তো মহান দাতা)। কখনো সূরা ইব্রাহিমের ৪০-৪১ নম্বর আয়াত: “رَبِّ اجْعَلْنِي مُقِيمَ الصَّلَاةِ وَمِن ذُرِّيَّتِي” (ওগো আমার প্রতিপালক, আমার রব, আমাকে আমার এই প্রার্থনার অনুগামী রাখো, আর আমার বংশধরদের মধ্য থেকেও)। “رَبَّنَا وَاغْفِرْ لِي وَلِوَالِدَيَّ وَلِلْمُؤْمِنِينَ يَوْمَ يَقُومُ الْحِسَابُ” (হে আমার প্রতিপালক, যেদিন হিসাব হবে, সেদিন আমাকে, আমার পিতা-মাতাকে, আমার ভক্তগণকে ক্ষমা করো)। কখনো সূরা ফুরকানের ৭৪ নম্বর আয়াত: “رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ أَزْوَاجِنَا وَذُرِّيَّاتِنَا قُرَّةَ أَعْيُنٍ” (হে আল্লাহ, হে আমার রব, আমার জন্য এমন সঙ্গী ও সন্তান‑সন্ততি দান করো, যারা আমার চোখ জুড়িয়ে দেবে, যারা আমার নয়নের জন্য প্রীতিকর)। “وَاجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِينَ إِمَامًا” (আর আমাকে মুত্তাকীদের ইমাম বানিয়ে দাও)। কারণ আমি তো জানি যে, মুত্তাকী হচ্ছে সূরা হুজরাতের ১৩ নম্বর আয়াত অনুযায়ী, আল্লাহর দৃষ্টিতে সবচেয়ে বেশি সম্মানিত। দুনিয়া এবং আখিরাতে সেই মুত্তাকীদের আমি ইমাম হতে চাই, সেই দোয়া করি (সূরা ফুরকানের ৭৪ নম্বর আয়াত )। এইভাবে হৃদয় নিংড়ানো প্রার্থনা সমাপ্তির অসংখ্য আয়াত আপনি পবিত্র কোরআনে খুঁজে পাবেন। সেগুলো দেখে দেখে সেইভাবে আল্লাহর কাছে ভিক্ষা চাইবেন, প্রার্থনা করবেন। এগুলো বুঝে যদি আপনি পড়েন, আল্লাহর কাছে চাইতে পারেন,

আপনার হৃদয় গলবে, আপনার এই নামাজে, আপনার প্রার্থনায়, আপনার ভিক্ষা চাওয়ায় একনিষ্ঠতা আসবে। আর যদি না বুঝে পড়েন, কোনো ক্রিয়াও নাই, কোনো প্রতিক্রিয়াও নাই, কোনো অ্যাকশনও নাই, কোনো রিএকশনও নাই। এবার নামাজ নিয়ে কোরআনের আয়াতগুলো একটু দেখুন। সূরা বনী ইসরাইলের ৭৮-৭৯ নম্বর আয়াত: “সূর্য ঢলে পড়ার পর থেকে রাতের অন্ধকার পর্যন্ত আর ফজরের সময় কোরআন তেলাওয়াত করুন। আর রাত্রি জাগরণ করুন আপনার জন্য এ হচ্ছে অতিরিক্ত। কারণ আল্লাহ চান আপনাকে সর্বোচ্চ সমাসীন করতে।” এই সূরা বনি ইসরাইলের ৭৮-৭৯ নম্বর আয়াতে এখানে কিন্তু সালাত শব্দটা আছে। আয়াতে যে সূর্য হেলে পড়ার পর (ঢলে পড়ার পর) রাতের অন্ধকার পর্যন্ত। এখন কেউ কি বলুন, সূর্য যে হেলে পড়ে (একটা-দুইটার দিকে), ওখান থেকে রাতের অন্ধকার (সন্ধ্যা আটটা-নটা পর্যন্ত), পৃথিবীর কোনো মুসলিম কি নামাজ পড়ে? পড়ে না! তাহলে এই কথার অর্থ কি? আসলে এই কথার অর্থ বলতে সেই সেই যে প্রথমে যে সিরাতে ইবনে হিশাম থেকে বলেছিলাম যে, আগের নবী-রাসূলরা এইভাবে দুই ওয়াক্ত পড়তো নামাজে, ওই সেটাই বোঝানো হয়েছে।

যে সূর্য হেলে পড়ার পর বলতো ওই আসরের সময়টাই (মানে সে বিকেলের সময়টা), কারণ সন্ধ্যা রাত হয়ে গেলে তো মানুষ ওইভাবে সময় দিতে পারবে না। তখন তো বিদ্যুতের যুগ ছিল না। ওই বিকেল বেলা তখন খুব গরমও লাগে না, খুব শীত লাগে না, চোখে সবকিছু দেখা যায়। ওই সময়টাকে আল্লাহ ইন্ডিকেট করেছেন। আর যদি প্রকৃত অর্থ ধরা হয়, তাহলে সূর্য হেলে পড়ার পর থেকে তো মানুষকে সেই একটা সময় নামাজে দাঁড়াতে হবে সন্ধ্যা আটটা পর্যন্ত। এভাবে পৃথিবীর কোনো মুসলিম কি নামাজ পড়ে? কেউ পড়ে না।

আর হচ্ছে, “রাত্রি জাগরণ করুন”। এখানে যে তাহাজ্জুদ বলা হচ্ছে, এই তাহাজ্জুদ তো আসলে আমরা সূরা মুজাম্মিলও পড়েছি। তাহাজ্জুদ বলতে তো রাত্রি জাগরণ। এখানে তাহাজ্জুদ তো কোনো নামাজ নয়। এবং ওইখানে আল্লাহ কি করতে বলেছেন? আল্লাহর রাসূলকে? আপনি সূরাটা পড়লেন দেখবেন যে আল্লাহ বলেছেন , “তুমি ধীরে ধীরে স্পষ্টভাবে কোরআন পাঠ করো।” কারণ সে যদি নিজেই এগুলো প্র্যাকটিস না করে, পরদিন যে শত শত হাজার হাজার সাহাবীরা আসবে, তাদেরকে সে কিভাবে শোনাবে? এজন্য রাত্রে তার নিজেরও প্র্যাকটিস করার দরকার আছে। এবার দেখুন নামাজ নিয়ে আরেকটা আয়াত, সূরা হুদের ১১৪ নম্বর আয়াত: “সালাত কায়েম করো দিনের দুই প্রান্তে ও রজনীর প্রথম অংশে।”

এখানে যে দুইটা আছে, “তারাফাইন নাহার” আর হচ্ছে “মিনাল লাইল”। “নাহার” মানে তো আমরা সবাই জানি দিন, আর “লাইল” মানে হচ্ছে রাত। মানে দিনের দুই প্রান্ত আর রাতের কিছু অংশ। মানে হচ্ছে, দিনের দুই প্রান্তের শেষ অংশে রাতের সামান্য অংশ পর্যন্ত। এই শব্দ দুইটারই মানে/ভাবার্থ হচ্ছে বিপরীত। দিন‑রাতের দুই প্রান্ত মানে কি? মানে খুব সোজা, যে একটা হচ্ছে সেই ফজর, আরেকটা হচ্ছে সেই সন্ধ্যা (মানে সেই আসর থেকে মাগরিবের ওই সময়টুকু পর্যন্ত)। এবার দেখুন ইসলামী ফাউন্ডেশনের সেই ইবনে কাসীরের যে তাফসীর, সেখানে ফুটনোটে কি দেয়া আছে।

ওইখানে দেয়া আছে যে, দিনের প্রথম প্রান্তভাগে ফজরের সালাত, দ্বিতীয় প্রান্তভাগে যোহর ও আসরের সালাত, রাতের প্রথম অংশে মাগরিব ও এশার সালাত। মোটেই পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরজ। এখন আপনি বলুন তো, সূরা হুদের ১১৪ নম্বর আয়াত এখানে কি পাঁচটা সময়ের কথা বলছে? আল্লাহ কিন্তু পাচটা সময়ের কথা বলেননি। তার মানে এই যে, কোরআনের ডাইরেক্ট অপব্যাখ্যা । তাফসীর ইবনে কাসীরে মানে ওই যে হাদিস, মিরাজের হাদিস, ওইখানে মিলাতে হবে, যেটা আলোচনার প্রথমে আজকে বলেছিলাম যে, লাহু য়াল হাদিস অনুসারীরা বলে যে, হেরে গেল কোরআন, জিতে গেল হাদিস। “তোমাদের কোরআন হেরে গেছে। কোরআনে তোমরা দাবি করো যে পরিপূর্ণ জীবন বিধান, সবকিছু আছে। নাই তো! কোরআন যে অপূর্ণ, পরিপূর্ণ জীবন বিধান নয়। যে আল্লাহপাক দাবি করেছেন কোরআনের অসংখ্য আয়াতে, সেটাকে মিথ্যা প্রমাণ করার জন্য ইবনে কাসীর, ইবনে মওদুদী, ইবনে তাবারী, এরা সবাই এই ফুটনোট নিজের মনগড়া দিয়েছে।”

এবার দেখুন সূরা রুমের ১৭-১৮ নম্বর আয়াত:
“সুতরাং তোমরা আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করো সন্ধ্যায় ও প্রভাতে। আর আসমানসমূহ ও পৃথিবীতে তাঁরই প্রশংসা, সন্ধ্যায় ও যখন তোমরা দ্বিপ্রহরে উপস্থিত হও।“
এখানেও সালাত শব্দটাই নেই। “সন্ধ্যায় ও প্রভাতে” বলতে ফজর ও মাগরিবের সময়কে ইঙ্গিত করা হয়েছে। “দ্বিপ্রহরে উপস্থিত হও” বলতে দিনের মধ্যবর্তী সময়কে বোঝানো হয়েছে, যা যোহরের সালাতের সময়ের সাথে মিলে না। বরং এটা দিনের কর্মব্যস্ততার মধ্যে আল্লাহর স্মরণে নিবেদিত হওয়ার কথা বলে।

সূরা কাফের ৩৯-৪০ নম্বর আয়াত:
“তুমি তোমার প্রতিপালকের সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করো সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের পূর্বে। রাতের একাংশে এবং সেজদার পরেও তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করো।“
এখানে সূর্যোদয়ের পূর্বে (ফজর) ও সূর্যাস্তের পূর্বে (আসর) সময়ের কথা বলা হয়েছে। রাতের একাংশে তাহাজ্জুদ ও সেজদার পরের সময়টিও উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এগুলোকে পাঁচ ওয়াক্তের সাথে জোর করে মেলানো যায় না। বরং এটা স্বতঃস্ফূর্ত প্রার্থনা ও কোরআন পাঠের সময় হিসেবেই বোঝা যায়।

সূরা বাকারার ২৩৮ নম্বর আয়াতের গভীরতা:
“তোমরা সালাতের প্রতি যত্নবান হবে, বিশেষত মধ্যবর্তী সালাতের। আর আল্লাহর উদ্দেশ্যে তোমরা বিনীতভাবে দাঁড়াবে।“
এই আয়াতে “মধ্যবর্তী সালাত” বলতে দিনের মূল কর্মঘণ্টার মধ্যে আল্লাহর স্মরণকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কোনো নির্দিষ্ট ওয়াক্ত নয়, বরং সারাদিনের কাজের ফাঁকে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক অটুট রাখার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীকালে এই আয়াতকে যোহরের সালাতের সাথে জুড়ে দেওয়া হয়েছে, যা কোরআনের সরল অর্থের সাথে সাংঘর্ষিক।

মিরাজের ঘটনা ও পাঁচ ওয়াক্তের প্রবর্তন:
হাদিস অনুযায়ী, মিরাজের রাতে আল্লাহ পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরজ করেন। কিন্তু কোরআনে মিরাজের ঘটনায় সালাতের সংখ্যা বা সময় উল্লেখ নেই। সূরা বনি ইসরাইলের ১ নম্বর আয়াতে শুধু বলা হয়েছে, “পবিত্র মহান তিনি, যিনি রাতের অন্ধকারে তাঁর বান্দাকে মাসজিদুল হারাম থেকে মাসজিদুল আকসায় ভ্রমণ করিয়েছেন…”। এখানে সালাতের কোনো উল্লেখ নেই। অতএব, পাঁচ ওয়াক্তের বিধান হাদিসনির্ভর, যা কোরআনের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক নয়, কিন্তু কোরআনের ব্যাখ্যাকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত।

ইতিহাসের স্বাক্ষ্য:
ইসলামের প্রাথমিক যুগে সাহাবায়ে কেরাম দুই ওয়াক্ত সালাত আদায় করতেন বলে ঐতিহাসিক দলিলে উল্লেখ আছে। ইবনে ইসহাকের “সিরাতুন নবী” ও ইবনে হিশামের বর্ণনায় দেখা যায়, মক্কী জীবনে রাসূল (সা.) ও সাহাবিগণ গোপনে ফজর ও মাগরিবের সালাত আদায় করতেন। মদিনায় হিজরতের পর ধীরে ধীরে অন্যান্য ওয়াক্ত যুক্ত হয়। এটা প্রমাণ করে যে, সালাতের সংখ্যা পরিস্থিতি ও প্রয়োজনের ভিত্তিতে বিবর্তিত হয়েছে।

উপসংহার:
কোরআন হলো আল্লাহর সরাসরি বাণী, যা চিরস্থায়ী ও পূর্ণাঙ্গ। হাদিস মানুষের বর্ণনা, যা সময় ও প্রেক্ষাপটের সাথে পরিবর্তনশীল। কোরআনের সুস্পষ্ট আয়াতগুলোতে দুই ওয়াক্ত সালাতের ইঙ্গিত থাকলেও পরবর্তীতে হাদিসের মাধ্যমে পাঁচ ওয়াক্ত চালু হয়েছে। এটা কোনো দোষের নয়, বরং প্রয়োজনানুসারে শরিয়তের নমনীয়তা প্রকাশ করে। তবে কোরআনকে প্রাথমিক উৎস হিসেবে গ্রহণ করে এর সরল ব্যাখ্যার প্রতি ফিরে যাওয়া উচিত। সালাতের মূল উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর সাথে যোগাযোগ, যা যেকোনো সময়, যেকোনো স্থানে সম্ভব। সংখ্যা বা রীতির চেয়ে নিয়ত ও একাগ্রতাই প্রধান।

2 thoughts on “নবী রাসুল পীর দরবেশ ও আমার নামাজ !

  1. সালাত/নামাজ সম্পর্কে এই লেখাটি আমি সম্পূর্ণ পড়েছি শুকরিয়া সৃষ্টিকর্তার দরবারে যিনি এই লিখুনি লিখেছেন। তিনি সঠিক যাচাই‑বাছাই করে বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। সাধারণ মানুষদের বোঝার জন্য সহজ।

  2. আমি এটা বুঝতে পারি নাই যে ছলাত মানে কী কুরান চর্চা নাকি কিছু চাওয়া আল্লাহর কাছে ?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *