আমি কিভাবে নামাজ পড়ি? কুরআনে নামাজ কয় ওয়াক্ত? নবীরা কিভাবে নামাজ পড়েছেন? (পর্ব ৮)

সালাত

সবচেয়ে বেশি মুত্তাকী তো মানুষ বুঝতে পারতো যে, আল্লাহর চোখে ধনী-গরীব, সাদা-কালো, গরীব‑দুঃখী, নারী-পুরুষ—কারো কোনো ভেদাভেদ নেই। এটা এমন একটা ধর্ম, এখানে কোনো ব্রাহ্মণ‑ক্ষত্রিয়-বৈশ্য‑নমশূদ্র ভেদাভেদে নাই। এখানে সকল মানুষ সমান, এবং সেই মানুষদের মধ্যেই যে সবচেয়ে বেশি মুত্তাকী, আল্লাহর দৃষ্টিতে সে সবচেয়ে বেশি সম্মানিত। এবং হাশরের মাঠে যারা মুত্তাকী হতে পারবে, তাদেরকে আল্লাহ স্পেশাল গেস্ট, বিশেষ অতিথি হিসেবে সেদিন সম্মানিত করবেন। এটা এমন একটা ধর্ম যে ধর্মে বলে—সূরা বাকারার ১৭৭ নাম্বার আয়াতে: “সম্পদের প্রতি ভালোবাসা সত্ত্বেও তোমরা তোমাদের অর্থসম্পদ দান করো অসহায়, এতিম, আত্মীয়-স্বজন ও দুঃখী-ভিখারী-মুসাফিরদের জন্য। তোমরা ধৈর্যশীল হও, তোমরা সত্যবাদী হও; তাহলে তোমরা হতে পারবে মুত্তাকী।” এই ধর্মটাকে মুত্তাকী যারা হতে পারে, তাদেরকে সবচেয়ে বেশি প্রায়োরিটি দেয়া হয়, সবচেয়ে বেশি সম্মানিত করা হয়, সবচেয়ে বেশি আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন বলা হয়। এই ধর্মে ইনসাফ, ন্যায়বিচার, মানুষের প্রতি জুলুম না করার নির্দেশ দেয়। এত চমৎকার একটা ধর্ম, তখন মানুষ উদ্বেলিত হয়ে যায়, উল্লসিত হয়ে যায়, এবং সে আশেপাশের মানুষকে এসে বলে: “জানো, এক রাসূল এসেছে আমাদের কাছে। সে নিজের মুখ থেকে যা বলে, তার নিজের কোনো কথা নয়; সে আল্লাহর কথা বলে। আর এই আল্লাহ এমন আল্লাহ, যে মানুষকে ইনসাফের নির্দেশ দেয়, মানুষকে সৎ কাজের নির্দেশ দেয়, এবং এর বিনিময়ে অনন্ত সুখের জান্নাত অফার করে।” সূরা নাহলের ৯০ নাম্বার আয়াতে যেমনটা আছে—হয়তো আল্লাহর রাসূল এইভাবেই মানুষকে শোনাতো: “নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, মানুষের সাথে সুন্দর আচরণ ও আত্মীয়-স্বজনকে দানের নির্দেশ দেন, এবং তিনি নিষেধ করেন অশ্লীলতা, অসৎ কাজ ও বাড়াবাড়ি করতে। তিনি তোমাদেরকে উপদেশ দেন, যাতে তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করো।” মানুষ এ‑ধরনের বাণী শুনে পাগলের মতো হয়ে যেত যে, এত চমৎকার একটা ধর্ম! যেই ধর্মে ধনী-গরীব কোনো ভেদাভেদ নেই, এবং এই ধর্মে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সবকিছু দান করে আত্মশুদ্ধির (তাসকিয়া নফসের) আদেশ দেন মহান আল্লাহ। এই ধর্মে বলা হয়েছে সূরা আহযাবের ৩৫ নাম্বার আয়াতে: “সে নারী হোক বা পুরুষ হোক, সে যদি মুমিন হয়, সত্যবাদী হয়, সে যদি ন্যায়পরায়ণ হয়, সে যদি ইনসাফকারী হয়, সে যদি ধৈর্যশীল হয়—তাহলে তার জন্য রয়েছে জান্নাত। এখানে নারী-পুরুষের কোনো ভেদাভেদ নেই, না গরীব‑ধনীর কোনো ভেদাভেদী নেই। কি চমৎকার একটা ধর্ম!” মানুষ পাগলের মতো এই ধর্মকে তখন আলিঙ্গন করতো।

ধর্ম সম্পর্কে মানুষ কিভাবে জানতো? এই যে প্রথমেই যে বললাম—সেই সিরাতে ইবনে হিশাম থেকে আর রাহিকুল মাখতুম থেকে—যে সকাল আর বিকেল (মানে সন্ধ্যায়) আল্লাহর রাসূল উপস্থিত হতেন। দলে দলে মানুষ সেখানে সমবেত হতো, আর আল্লাহর রাসূল এই কোরআন থেকে তাদের শোনাতেন ঐশী বাণী। আর শুনতে শুনতে যেহেতু অল্প কিছু একসাথে হতো (তখন এই সোয়া ছয় হাজার আয়াত ছিল না; অল্প অল্প করে নাযিল হতো), মানুষ সকালে শুনতো, বিকেলে শুনতো, পরদিন সকালে শুনতো, বিকালে শুনতো। শুনতে শুনতে শুনতে মানুষের এত ভালো লাগতো এই বাণীগুলো যে, কি চমৎকার মানবতার একটা ধর্ম! মানুষ তার আশেপাশের মানুষকে বলতো, তার পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের সবকিছুর মধ্যে তারা একটা স্বপ্ন দেখতো যে, সবকিছুই এক। এই পৃথিবীটাই শান্তিময় বেহেশতের বাগান হয়ে যাবে, যদি এই আল্লাহর আদেশ‑নিষেধগুলো মেনে চলতে পারি আমরা। কত চমৎকার একটা ধর্ম! এইভাবে শুনতে শুনতে সকাল আর বিকেলে মানুষের এই আয়াতগুলো মুখস্ত হয়ে যেত। আর এইভাবেই প্রত্যেক যুগে যুগে আল্লাহর রাসূল, নবী-রাসূল যারা এসেছেন, তারা এইভাবেই মানুষকে আল্লাহর বাণী শুনিয়েছিলেন।

তাদের এই যে সাহাবী—২০০০, ৫০০০, ১০০০০, ২০০০০, ৫০০০০, ১ লক্ষ, হাজার হাজার সাহাবী—এদের সবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে রাসূলদের পক্ষে কি এই আল্লাহর বাণী করা (তাবলিগ করা) সম্ভব? কখনোই সম্ভব না! তার শত শত বছরও লাগবে। যদি ২০,০০০ সাহাবীদের প্রত্যেকের ঘরে ঘরে গিয়ে, আজকে নাযিল হলো ২০টা আয়াত—এই ২০টা আয়াত যদি ২০,০০০ সাহাবী সবার ঘরে ঘরে গিয়ে পৌঁছাতে হয়, তাবলিগ করতে হয়—দুই‑চার‑পাঁচ হাজার বছরও সে পারবে না। এ কারণেই এই সকাল আর সন্ধ্যা—সকল নবীরা এই সময়টাতেই নামাজ পড়তেন। এই সময়টাতেই তারা এই আল্লাহর বাণী মানুষকে পৌঁছে দিতেন। এবং আমরা হাদিসে শুনেছি যে, আল্লাহর রাসূল এমন দীর্ঘ নামাজ পড়তেন যে, তার দু’পা ফুলে যেত। হয়তো তিনি প্রথম রাকাতে সূরা বাকারা, পরের রাকাতে সূরা ইমরান পড়তেন। এই দুই রাকাত নামাজের তিন ঘন্টা শুধু আল্লাহর বাণী তিনি বলতেন। রুকু-সেজদা করতে হয়তো বড় পাঁচ মিনিট সময় লাগতো; আর দুই ঘন্টা ৫৫ মিনিটে তিনি আল্লাহর বাণী তেলাওয়াত করতেন। সূরা মুজাম্মিলে আমরা দেখি যে, তিনি ধীরে ধীরে স্পষ্টভাবে আল্লাহর বাণী তেলাওয়াত করতেন।

তো এই যে সৃষ্টির শুরু থেকেই দুই ওয়াক্ত যে নামাজে মানুষকে আল্লাহর ঐশি বাণী শোনানো—এই যে কনফারেন্স করা—এটা কিভাবে পাঁচ‑ছয়‑সাত ওয়াক্ত হয়ে গেল? ইশরাক, চাশত, হাজত, নফল, আওয়াবিন… আরো আছে: খুফের নামাজ, এর সাথে আছে তারাবি, কুসুফ‑খুসুফ, চাশত, আশুরা, জায়নামাজ, জানাজা, শুকরিয়া, বৃষ্টির নামাজ, ভয়ের নামাজ, সাকরাতুল মৌতের নামাজ… মানে নামাজের কোনো সীমা-পরিসীমা নাই। মানে ২০-৩০-৪০ ওয়াক্ত বানিয়ে ফেলেছে! কিন্তু এর যে মূল উদ্দেশ্য—কি? আল্লাহর বাণী মানুষকে পৌঁছানো—সেটা থেকেই বঞ্চিত করা হচ্ছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে, আমরা তো আর সেই আল্লাহর নবীদের মতো মানুষের কাছে আমাদের বাণী পৌঁছাতে হবে না। আমরা নিজেরা কি করব? নিজেরা কিভাবে নামাজ আদায় করব? তার উত্তর খুব সহজ। আমি প্রত্যেকটা পর্বতেই বলেছি যে, ফার্সিতে যে ‘নামাজ’টা ব্যবহার করা হয়, এর অর্থ হচ্ছে প্রার্থনা করা, ভিক্ষা করা, মোনাজাত করা, দোয়া করা। সবচেয়ে বড় দোয়া হচ্ছে এই নামাজ। তো আল্লাহর কাছে দাঁড়িয়ে আপনি আল্লাহর কাছে দোয়া করবেন, কাকুতি-মিনতি সহকারে—যেমনটা আল্লাহ কোরআনের পাতায় পাতায় বলেছেন। তার যে ইউসুফ নবী, ইব্রাহিম নবী, ইউনুস নবী, মুসা নবী, ঈসা নবী, আইয়ুব নবী—সবাই আল্লাহর কাছে এইভাবেই নামাজ পড়তে, এইভাবে ভিক্ষা চাইতো। সেই আইয়ুব নবী কত অসুখ‑দুঃখ‑কষ্টে ভুগে তিনি আল্লাহর কাছে এইভাবে ভিক্ষা চেয়েছেন: “ওগো আল্লাহ, আমি আর পারছি না। আমি আর দুঃখ‑কষ্ট সইতে পারছি না। তুমি তো দয়ালুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু।” আল্লাহপাক সাথে সাথে তার সেই প্রার্থনা মঞ্জুর করেছেন। ইউনুস নবী বলেছিলেন: “ওগো আল্লাহ, আমি তো নিজের প্রতি জুলুম করেছি। আল্লাহ, তুমি ছাড়া আমার আর কে আছে?” সাথে সাথে আল্লাহপাক তার সেই প্রার্থনা, তার ভিক্ষা যে তিনি চেয়েছেন, সেটা মঞ্জুর করেছেন। মুসা নবী একজনকে খুন করে, যিনি রাজপুত্রের মতো জীবন কাটিয়েছেন, সে মাদিয়ান শহরে এসেছে। তার পকেটে টাকা নাই, পয়সা নাই, দু মুঠো ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা নাই, চাকরি নাই, বাকরি নাই, থাকার জায়গা নাই, ঘরবাড়ি কিচ্ছু নাই—অজানা-অচেনা এক শহরে এসে তিনি উপস্থিত হয়েছেন। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে—এমন নিঃস্ব, অসহায়, রিক্তশূন্য একজন মানুষ আল্লাহর কাছে ভিক্ষা চেয়েছে: “ওগো আল্লাহ, তুমি আমাকে যেই নিয়ামত দাও, আমি তো তারই ভিখারী।” সাথে সাথে আল্লাহ তার সেই ভিক্ষা, সাথে সাথে আল্লাহ তার সেই প্রার্থনা মঞ্জুর করেছেন। তার বিয়ের ব্যবস্থা করেছেন, তার থাকার ব্যবস্থা করেছেন, তার চাকরির ব্যবস্থা করেছেন, তার ঘরের ব্যবস্থা করেছেন, তার খাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন—সবকিছু আল্লাহ মিটিয়ে দিয়েছেন।

কোন নবী-রাসূলের এর জীবনের কাহিনী—আল্লাহ যতগুলো নবী-রাসূলদের জীবনের কাহিনী—বিপদ-আপদে কে কোন সময় কিভাবে আল্লাহর কাছে ভিক্ষা চাইতো, প্রার্থনা করতো, আল্লাহ বর্ণনা করেছেন। কোথাও সেই হাত কোথায় বাঁধবে (পেটে না বুকে)—এইসব কোনো বিষয়ে আল্লাহ আলোচনা করেননি। তিনি মূল জিনিসগুলোর প্রতি, কথাগুলোর প্রতি ফোকাস করেছেন। আমরা সেইভাবে, সেই আবেগ‑অনুভূতি নিয়ে, মনের অন্তরের অন্তস্থল থেকে, হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা থেকে, ইমোশন দিয়ে আল্লাহর কাছে ওইভাবে মুসা নবীর মত, ঈসা নবীর মত, আইয়ুব নবীর মত প্রার্থনা করব। আল্লাহর কাছে চাইবো আমার যা লাগে: আমার অভাব‑অনাটন, দুঃখ‑কষ্ট, বেদনা—অনুযায়ী আমি সেইভাবে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করব।

তবে প্রার্থনার শুরুতেই আমি যেটা করি, সেটা আপনার সাথে শেয়ার করি: প্রার্থনার শুরুতেই মনে রাখতে হবে যে, আমরা যা বলি, সেটা যদি বুঝে না বলি, এই প্রার্থনার, এই ভিক্ষা কোনদিনও মঞ্জুর হওয়ার কথা নয়। একজন ইংরেজ যদি বাংলা ভাষায় আপনার কাছে কোনো ভিক্ষা চায়, কোনো কিছু চায়—সে নিজেও বুঝে না কি বলে—আপনি কখনো সেই তার সেই প্রার্থনা বা ভিক্ষা চাওয়া আপনার হৃদয় গলাতে পারবে না। কারণ সে সেই বাংলাটা তো তার নিজের ভাষায় না। সেই অন্তরের অন্তস্থল থেকে সেই ইমোশন তার কখনোই আসবে না। এজন্য আমি যেটা করি, প্রথমে সূরা ফাতিহা প্রথমেই বলি: “আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামিন”—ওগো আল্লাহ, সকল প্রশংসা তোমার। তুমি তো সমগ্র বিশ্বের প্রতিপালক। আর “রহমানির রাহিম”—তুমি তো পরম দয়ালু, দয়ার সাগর, অসীম দয়াময়। মনের ভিতরে সেই বাংলাটা ওইভাবে নিয়ে আসি। “ইয়াকা নাবুদু”—আল্লাহ গো, আমি তো শুধু তোমারই গোলামী করি, তোমার দাসত্ব করি। তোমার যত আদেশ‑উপদেশ আছে, সমস্ত কিছুর একজন গোলাম। একজন চাকর, একজন দাস যেমন তার মনিবের সকল আদেশ‑নিষেধ মেনে চলে না চললে, তাকে সেই চাকরি থেকে তাড়িয়ে দেয়, ঘর থেকে বের করে দেয়—ঠিক তেমনি, আমি সেরকম। সেই মনিব তুমি তো আমার মনিব। তোমার সকল আদেশ‑উপদেশ আমি মেনে চলি। আমি সুদ খাই না, আমি ঘুষ খাই না, আমি মানুষের উপর জুলুম করি না, গীবত করি না, মিথ্যা বলি না। আমি সামর্থ্য অনুযায়ী মানুষের উপকার করি, মানুষকে দান করি, আত্মীয়-স্বজন, অভাবী, প্রতিবেশী, তাদেরকে দেয়ার চেষ্টা করি। মানুষের উপর ইনসাফ করি, মানুষের সাথে সদয় আচরণ করি। এবং এগুলো আমি অব্যাহত রাখবো, আল্লাহ। কারণ আমি তোমার প্রকৃত গোলাম, প্রকৃত দাস হতে চাই। আমি এখন তোমার কাছে সাহায্য চাই, আল্লাহ। কি সাহায্য জানো? এখন আমি যে তোমার দাস, তোমার গোলাম—সেই অধিকারে, আল্লাহ, আমি তোমার কাছে “ইয়াকা নাস্তাইন”—তোমার কাছে সাহায্য চাই। আল্লাহ, কি সাহায্য জানো? “ইহদিনাস সিরাতাল মুস্তাকিম”—তুমি আমাকে সহজ-সরল সঠিক পথ দেখাও। “সিরাতুল মুস্তাকিম” দেখাও—যেই পথে গেলে আমি জান্নাতে যেতে পারব। আমি জাহান্নামের কঠিন আগুনে যেতে চাই না, আল্লাহ! “সিরাতাল্লাজিনা আনআমতা আলাইহিম”—সেই পথ, যেই পথে তোমার প্রিয় বান্দারা গিয়েছে, প্রিয় গোলামেরা, প্রিয় চাকরেরা, প্রিয় দাসেরা গিয়েছে। “গায়রিল মাগদুবি আলাইহিম”—সেই পথে নয় গো আল্লাহ, যে পথে চললে তোমার গজব নাযিল হবে, তোমার অভিসম্পাত নাযিল হবে। সেই পথটা কি? আমি তো জানি, আল্লাহ। সেই পথে চললে ঘুষ খেতে হয়, সুদ খেতে হয়, মানুষের উপর জুলুম করতে হয়, মানুষকে ঠকাতে হয়, খাদ্যে ভেজাল দিতে হয়, মানুষের সাথে খারাপ আচরণ করতে হয়, গীবত করতে হয়, মিথ্যা বলতে হয়—এইরকম পথে আমি চলতে চাই না, আল্লাহ। এই পথে তো চলতে তুমি আমাকে কোরআনের পাতায় পাতায় নিষেধ করেছো। এই পথে চললে আমার উপর গজব নাযিল হবে, অভিসম্পাত নাযিল হবে। এই পথে আমি চলতে চাই না। সেই পথ থেকে তুমি আমাকে বাঁচাও, আল্লাহ!

এইভাবে মনের আকুতি নিয়ে প্রথমে সূরা ফাতিহাটা পাঠ করি। তারপর কখনো সূরা বাকারার ২৮৬ নাম্বার আয়াত: “ওগো আমার রব, যদি আমি ভুলে যাই অথবা ভুল করি, তুমি আমাকে অপরাধী করো না। ওগো আমার রব, আমাদের পূর্ববর্তীগণের উপর যে গুরু দায়িত্ব অর্পণ করেছিলে, আমাদের উপর তেমন গুরু দায়িত্ব অর্পণ করো না। ওগো আমার প্রতিপালক, এমন ভার আমাদের উপর অর্পণ করো না, যা বহন করার শক্তি আমার নাই। আমার পাপগুলো মোচন করে দাও, আমাকে ক্ষমা করে দাও, আমার প্রতি তুমি দয়া করো। তুমি তো আমার মাওলা, আমার অভিভাবক। সুতরাং বর্বরদের পথে আনতে আমাকে সাহায্য করো।”

কখনো সূরা আল ইমরানের ৮‑৯ নাম্বার আয়াত: “ওগো আমার প্রতিপালক, সরল পথ (সিরাতুল মুস্তাকিম) দেখানোর পর তুমি আমাকে সেই পথ থেকে আর বিচ্যুত করো না। তুমি আমাকে তোমার নিকট থেকে দয়া করো, করুণা দাও। তুমি তো মহান দাতা।”

কখনো সূরা ইব্রাহিমের ৪০-৪১ নাম্বার আয়াত: “ওগো আমার প্রতিপালক, আমার রব, আমাকে আমার এই প্রার্থনার অনুগামী রাখো আর আমার বংশধরদের মধ্য থেকেও। হে আমার রব, আমার প্রার্থনা তুমি বাস্তবায়িত করো। হে আমার প্রতিপালক, যেদিন হিসাব হবে, সেদিন আমাকে, আমার পিতা-মাতাকে, আমার ভক্তগণকে ক্ষমা করো।”

কখনো সূরা ফুরকানের ৭৪ নাম্বার আয়াত: “হে আল্লাহ, হে আমার রব, আমার জন্য এমন স্ত্রী ও সন্তান‑সন্ততি দান করো, যারা আমার চোখ জুড়িয়ে দেবে, আমার নয়নের জন্য প্রীতিকর। আর আমাকে মুত্তাকীদের ইমাম বানিয়ে দাও।” কারণ আমি তো জানি যে, মুত্তাকী হচ্ছে—সূরা হুজরাতের ১৩ নাম্বার আয়াতে বলেছে যে—মুত্তাকী হচ্ছে আল্লাহর দৃষ্টিতে সবচেয়ে বেশি সম্মানিত। দুনিয়া এবং আখিরাতে সেই মুত্তাকীদের আমি ইমাম হতে চাই। সেই দোয়া করি (সূরা ফুরকানের ৭৪ নাম্বার আয়াত অনুযায়ী)।

এইভাবে হৃদয় নিংড়ানো প্রার্থনা সমাপ্তির অসংখ্য আয়াত আপনি পবিত্র কোরআনে খুঁজে পাবেন। সেগুলো দেখে-দেখে সেইভাবে আল্লাহর কাছে ভিক্ষা চাইবেন, প্রার্থনা করবেন। এগুলো বুঝে যদি আপনি পড়েন, আল্লাহর কাছে চাইতে পারেন—আপনার হৃদয় গলবে। আপনার এই নামাজে, আপনার প্রার্থনায়, আপনার ভিক্ষা চাওয়ায় একনিষ্ঠতা আসবে। আর যদি না বুঝে পড়েন, কোনো ক্রিয়াও নাই, কোনো প্রতিক্রিয়াও নাই, কোনো অ্যাকশনও নাই, কোনো রিয়াকশনও নাই।

এবার নামাজ নিয়ে কোরআনের আয়াতগুলো একটু দেখুন:

  • সূরা বনি ইসরাইলের ৭৮-৭৯ নাম্বার আয়াত: “সূর্য ঢলে পড়ার পর থেকে রাতের অন্ধকার পর্যন্ত আর ফজরের সময় কোরআন তেলাওয়াত করুন। আর রাত্রি জাগরণ করুন। আপনার জন্য এ হচ্ছে অতিরিক্ত। কারণ আল্লাহ চান আপনাকে সর্বোচ্চ সমাসীন করতে।”
  • সূরা হুদের ১১৪ নাম্বার আয়াত: “সালাত কায়েম করবে দিনের দুই প্রান্তে ও রজনীর প্রথম অংশে।”
  • সূরা ত্ব‑হা-এর ১৩০ নাম্বার আয়াত: “সূর্যোদয়ের পূর্বে ও সূর্যাস্তের পূর্বে তোমার প্রতিপালকের সব প্রশংসা, পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করো। এবং রাত্রিকালে পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করা এবং দিবসের প্রান্ত পর্যন্ত।”
  • সূরা রুমের ১৭-১৮ নাম্বার আয়াত: “তোমরা আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করো সন্ধ্যায় ও প্রভাতে।”
  • সূরা আহযাবের ৪২ নাম্বার আয়াত: “সকাল‑সন্ধ্যায় আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করবে।”
  • সূরা কাফের ৩৯-৪০ নাম্বার আয়াত: “তোমার প্রতিপালকের সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করো। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের পূর্বে তার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করো। রাতের একাংশে এবং সেজদার পরে।”
  • সূরা বাকারার ২৩৮ নাম্বার আয়াত: “তোমরা সালাতের প্রতি যত্নবান হবে, বিশেষত মধ্যবর্তী সালাতের। এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে তোমরা বিনীতভাবে দাঁড়াবে।”

এই আয়াতগুলো থেকে স্পষ্ট যে, মূল সালাতের সময় ছিল দিনের দুই প্রান্ত (সকাল ও সন্ধ্যা) এবং রাতের কিছু অংশ। কিন্তু পরবর্তীতে বিভিন্ন হাদিস ও ফিকহশাস্ত্রে নামাজের ওয়াক্ত সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। কোরআনের মূল বার্তা হলো: আল্লাহর সাথে সরাসরি যোগাযোগ, অন্তরের একনিষ্ঠতা, এবং মানবতার সেবা। নামাজের রীতিনীতি যেন এই মূল উদ্দেশ্যকে ঢেকে না ফেলে।

3 thoughts on “আমি কিভাবে নামাজ পড়ি? কুরআনে নামাজ কয় ওয়াক্ত? নবীরা কিভাবে নামাজ পড়েছেন? (পর্ব ৮)

  1. অন্তরের অন্তস্থল থেকে ভালোবাসা আল্লাহর জন্য রিজওয়ান ভাই খুব সুন্দর হয়েছে খুব সুন্দর হয়েছে। আপনার জন্য দোয়া রইল আল্লাহর দরবারে।

  2. Alham­dulil­lah­hi rab­bil alamin,
    Khub sun­dor alochana korechen rejwan bhai,
    Allah apnar Valo koruk

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *