পরিবারে এবং আত্মীয়স্বজনের মধ্যে কুরআনের দাওয়াত দেয়ার ৫টি কৌশল?

ঈমান "কুরআন না বোঝার ৫ টি কারণ" কুরআন বোঝা কি সম্ভব? কারা বুঝবে?

সালামুন আলাইকুম। আজকে আমাদের খুতবার বিষয়—পরিবারে এবং আত্মীয়স্বজনের মধ্যে কীভাবে আমরা কুরআনের দাওয়াত পৌঁছে দেব, মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকব।

৯৮ নম্বর সূরা বাইয়িনার সাত নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন: “ইন্নাল্লাজিনা আমানু ওয়া ‘আমিলুস সালিহাতি উলায়িকা হুম খইরুল বারিয়্যাহ”—নিশ্চয়ই যারা ঈমান এনেছে ও কর্মকে সংশোধন করেছে, তারাই সৃষ্টির সেরা।

কুরআনে অজস্র আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, যারা ঈমান আনে ও কর্মকে সংশোধন করে, তারা সুনিশ্চিতভাবে জান্নাতে যাবে। ৪১ নম্বর সূরা ফুসসিলাত‑এর ৩৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন: “ওয়ামান আহসানু কাওলান মিম্মান দা’ই ইলাল্লাহি ওয়া ‘আমিলা সালিহাওঁ ওয়া ক্বালা ইন্নানি মিনাল মুসলিমীন।”—সেই ব্যক্তির কথার চেয়ে আর কার কথা উত্তম হতে পারে, যে মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকে, কর্মকে সংশোধন  করে এবং বলে, “আমি মুসলিমদের মধ্য থেকে একজন।”

এই আয়াতেও আমরা দেখলাম যে আল্লাহ কর্মকে সংশোধনের উপর জোর দিয়েছেন। আমরা যত বড় ঈমানদার হই না কেন, যদি আমাদের কর্মকে সংশোধন না করি সৎকর্ম না থাকে, নেক আমল না থাকে—Everything will go in vain. এই ঈমান আমাকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাতে পারবে না। হাশরের মাঠে, যখন মিজানের পাল্লায় আমার আমলনামা ওজন দেওয়া হবে, নেকীর পাল্লা যদি হালকা হয়ে যায়, আমি চিরতরে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব। সুরা আরাফের ৮,৯ ও সুরা মুমিনুনের ১০২,১০৩ আয়াতে যা পরিষ্কারভাবে আল্লাহ বলে দিয়েছেন। 

সুরা ফুসসিলাতের ৩৩ আয়াত আরেকটা বিষয় পরিষ্কার করে—আমাদের অবশ্যই মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত হতে হবে। মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার নির্দেশ আল্লাহ তাঁর রাসূলকেও দিয়েছেন।

২৭ নম্বর সূরা নামল-এর ৯১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাসূলকে বলছেন: —আমাকে আদেশ দেওয়া হয়েছে, যেন আমি মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত হই।

৯২ নম্বর আয়াতে: “ওয়া আন আতলুয়াল কুরআন।”—আর যেন আমি কুরআন অধ্যয়ন করি।

আল্লাহর রাসূলেরও পরিচয় ছিল: তিনি মুসলিম।

আপনাকে মুসলিম হতে হবে—No Shiya, No Sun­ni, No Iba­di, No Taziyani—No Ahle Hadith!

এরপর আপনার কর্মকে সংশোধন করতে হবে, সৎকর্ম করতে হবে। তাহলে আপনি সৃষ্টির মধ্যে উত্তম হবেন (সূরা বাইয়িনাহ ৭ নম্বর আয়াত অনুযায়ী), আবার আপনার কথাও উত্তম হবে (সূরা ফুসসিলাত ৩৩ নম্বর আয়াত অনুযায়ী)।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা যখন দাওয়াত দিতে যাই—আমাদের পরিবারে, আমাদের স্ত্রী, সন্তান, বাবা-মা, ভাই‑বোন, আত্মীয়স্বজনকে—তখন কেন আমাদের সাথে তাদের ঝগড়া-বিবাদ শুরু হয়ে যায়? তিক্ততার সম্পর্ক শুরু হয়ে যায়, অনেক সময় হাতাহাতি-মারামারি পর্যায়ে  চলে যায়। এর কারণ কী? এর কারণ কিন্তু এই দুইটি আয়াতের মধ্যেই আমরা পেয়ে যাই। এক, সূরা নামল-এর ৯২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাসূলকে যে নির্দেশ দিয়েছিলেন—“আমি যেন কুরআন অধ্যয়ন করি।”

সত্যি কথা বলতে দু:খজনক চরম বাস্তবতা হচ্ছে আমরা কুরআন অধ্যয়ন করি না। 

সূরা মুহাম্মদ-এর ২৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন: —তারা কি কুরআন নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা করে না? নাকি তাদের অন্তর তালাবদ্ধ?

আমরা যখন কুরআন নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা করব, আমাদের অন্তরের তালা খুলে যাবে।

ভালোভাবে কুরআন অধ্যয়ন না করার কারণেই আমরা অনেক কৌশল জানি না, এবং সেই কৌশল প্রয়োগ না করতে পারার কারণেই আমাদের দাওয়াতটা নেক উদ্দেশ্য থাকা সত্ত্বেও উল্টো সবার সাথে তিক্ত সম্পর্ক সৃষ্টি হয়।

আমরা যখন দাওয়াত দিতে যাব, আমাদের প্রথমেই মনে রাখতে হবে—এই দাওয়াত দেওয়া তো নবীদের মতো কাজ; আর এই দাওয়াত দিতে গিয়ে, মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকতে গিয়ে, নবী-রাসুলরা নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। নবী রাসূলদের মানুষ উন্মাদ বলত, পাগল বলত, মাথা খারাপ বলত, চর‑থাপ্পড়, কিল‑ঘুষি, মারধোর এসব তো ছিল প্রতিদিনকার মামুলি ঘটনার মতো। নুহ নবী সারে নয়শ বছর মানুষকে আল্লাহর দিকে ডেকেছেন। প্রায় প্রতিদিনই তিনি তাঁর কওমের হাতে মারধরের শিকার হয়েছেন। ঈসা নবীকে তো শুলেই চড়ালো, অনেক নবী রাসুলকে হত্যা পর্যন্ত তারা করেছে। তাহলে ভাবুন, এটা কত বড় ঝুঁকিপূর্ণ কাজ! কত বড় দুঃসাহসীক কাজ! মৃত্যুর ঝুঁকি আছে, মারধরের ঝুঁকি আছে, চরথাপ্পড়-কিল- ঘুসি-পাগল ও উন্মাদ অপবাদের বোঝা মাথা পেতে নেয়ার ঝুঁকি আছে। এরপরও নবী রাসূলরা কি থেমে ছিলেন? থামেননি। কারণ—আল্লাহ্‌র দিকে ডাকার চেয়ে শ্রেষ্ঠ কাজ এই পৃথিবীতে আর কি হতে পারে? এর চেয়ে বড় তৃপ্তির কাজ আর কিইবা হতে পারে?

সূরা ফুরকানের ৫২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তাঁর রাসূলকে বলেছেন এই কুরআন দিয়ে জিহাদ করার জন্য—এটা জিহাদে আকবার বা সবচেয়ে বড় জিহাদ। তো আল্লাহ্‌র রাসুল এই জিহাদ কিভাবে করেছেন কুরআন দিয়ে? তিনি কি কুরআন অস্ত্রের মতো রাইফেল বা তলোয়ারের মতো মানুষের মুখে ছুড়ে মারতেন? মারামারি করতেন? না! তিনি সুরা মুজাম্মিলের ৪,৫ আয়াত অনুযায়ী রাতের অর্ধেক সময় ধীরে ধীরে স্পষ্টভাবে কুরআন পাঠ করতেন, সুরা মুহাম্মাদের ২৪ আয়াত অনুযায়ী কুরআনের আয়াত নিয়ে চিন্তাভাবনা বা গবেষণা করতেন, সূরা নামলের ৯২ নম্বর আয়াত অনুযায়ী কুরআন অধ্যয়ন করে বিভিন্ন প্রজ্ঞা অর্জন করতেন। 

সুতরাং—নিজ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, নবীওয়ালা কাজ যখন আপনি করবেন, আপনাকে দুটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে:

১. আপনি হয়তো হত্যার শিকারও হতে পারেন। অপবাদ তো খুবই মামুলি ব্যাপার—মারধর তো খুবই সাধারণ। 

২. আপনাকে অবশ্যই প্রজ্ঞা অবলম্বন করতে হবে। কিভাবে? এক নজরে কুরআন থেকে  দেখি:

প্রথমেই, যখন আপনি আপনার প্রিয়জনকে, সে হতে পারে আপনার স্বামী, আপনার স্ত্রী, সন্তান, বাবা-মা, ভাই‑বোন, আত্মীয়স্বজন—কে ডাকবেন, যাকে আপনি খুব পছন্দ করেন, ভালোবাসেন, স্নেহমমতা করেন, যখন তাকে আল্লাহ্‌র কুরআনের দিকে ডাকতে যাবেন তখন সূরা কাসাসের ৫৬ নম্বর আয়াত মাথায় রাখবেন:

“নিশ্চয়ই তুমি যাকে ভালোবাসো, যাকে মহব্বত করো, (সেই প্রিয়জনকে) তুমি হেদায়েত দিতে পারবে না। বরং আল্লাহ যাকে চান তাকে হেদায়েত দান করেন।কারা হেদায়েত কবুল করবে তা তিনিই ভালো জানেন।”

এটাই হচ্ছে আপনার প্রথম প্রজ্ঞা: আল্লাহ্‌ বলছেন যাকে আপনি ভালবাসেন তাকে ইচ্ছে করলেই আপনি হেদায়াত দিতে পারবেন না। বরং এটা আল্লাহর হাতে। আল্লাহ্‌ যাকে ইচ্ছে করবেন তাকেই হেদায়াত দেবেন। 

আরেকটি আয়াত আপনার মনে রাখতে হবেঃ 

সূরা নামল (২৭ নম্বর সুরার)- ৮১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন:

“তুমি অন্ধদের পথভ্রষ্টতা থেকে (হেদায়েতের দিকে) ফিরিয়ে আনতে পারবে না; তুমি শুধু তাদেরকে শোনাতে পারবে যারা আমার আয়াতে ঈমান আনে।”

আল্লাহ্‌র আয়াত শোনার পরও যারা শুনেও শোনে না, সুরা বাকারার‑১৮ আয়াতের মতো ছুম্মুন বুক্মুন উমউন ফাহুম লা ইয়ারজিউন- আধ্যাত্মিকভাবে বধির ও অন্ধ, তাদেরকে আপনি সারা জীবন চেষ্টা করলেও শোনাতে পারবেন না। লুত নবী তাঁর স্ত্রীকেও হেদায়েত দিতে পারেননি। লুত নবীর স্ত্রীর হেদায়েত হয়নি, নূহ নবীর স্ত্রী পুত্র কারোই হেদায়েত হয়নি, ইব্রাহীম নবীর পিতার ও হেদায়েত হয়নি। তাহলে আপনি কি  নিজেকে তাদের চেয়েও বেশি যোগ্য মনে করবেন? যদি করেই থাকেন, you are a fool! আপনি বোকার স্বর্গে বাস করছেন।কুরআনের আয়াত আপনার চোখের পর্দা খুলতে পারেনি।

আরেকটি আয়াত সূরা বাকারা,  ২৭২:

তাদেরকে (হেদায়েতের)  সঠিক পথে নিয়ে আসা তোমার দায়িত্ব নয়, বরং আল্লাহ যাকে ইচ্ছে তাকে (হেদায়েতের)  সঠিক পথে পরিচালিত করেন।

আল্লাহ্‌র রাসূল তাঁর চাচা আবু তালেবকেও হেদায়াত দিতে  পারেননি। এই দায়িত্ব আমার বা আপনার কারোই নয়। 

তাহলে প্রশ্ন ওঠে রাসুলের দায়িত্ব কি ছিল? সূরা মায়েদার ৯২ও ৯৯ আয়াত পড়লে আমরা বুঝি যে আল্লাহর কুরআনের বাণী প্রচার ব্যতীত রাসুলের আর কোন দায়িত্ব নেই। রাসুলের দায়িত্ব শুধু আল্লাহ্‌র বানী মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া। 

সূরা ক্বাফের ৪৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ্‌ বলছেন ‘’তারা যা বলে তা আমি খুব ভালো করেই জানি। তুমি তাদের উপর জোর জবরদস্তিকারী নও। সুতরাং, যে আমার শাস্তিকে ভয় করে তাকে কুরআনের সাহায্যে উপদেশ দাও।‘’ 

তাই আপনি যখন আপনার স্বামী বা স্ত্রী বা আপনার পিতামাতা, ভাইবোন, আত্মীয় স্বজনকে দাওয়াত দেবেন তখন কি জোর জবরদস্তি করবেন? না একদমই না! কুরআন অনুসারে আপনি যদি দাওয়াত দিতে চান, আল্লাহ্‌র আদেশ নিষেধ মেনে চলতে চান, তাহলে মনে রাখবেন যে আপনি কারো উপর জোর‑জবরদস্তি বা বলপ্রয়োগ করতে পারবেন না।সুরা ইউনুসের ৯৯ আয়াতে আল্লাহ বলেন- “তোমার রব (আল্লাহ) যদি চাইতেন তাহলে পৃথিবীর সকল মানুষ ঈমান আনতো। তবে কি তুমি মানুষের ওপর জোর জবরদস্তি করবে যাতে তারা ঈমান আনে?” সুরা বাকারার ২৫৬ আয়াতে আল্লাহ বলেন‘’লা ইকরাহা ফিদ‑দ্বীন’’। দ্বীনের ব্যাপারে কোন জোর জবরদস্তি নেই। তাহলে আপনি কি করতে পারবেন? জোর জবরদস্তি বা বলপ্রয়োগ করা তো আল্লাহ হারাম বা নিষিদ্ধ করেছেন। সুতরাং আপনি সর্বোচ্চ যেটা করতে পারবেন তা হচ্ছে উপদেশ দিতে পারবেন। কিসের মাধ্যমে উপদেশ দেবেন? মানব রচিত হুজুর শরীফের লাহুয়াল হাদিসের মাধ্যমে? নাকি কুরআনের সাহায্যে? কুরআনে নাজিলকৃত রহমত শিফা ও নুর সমৃদ্ধ আয়াতের মাধ্যমে?

এবার আমরা আরেকটু গভীরভাবে দেখি — সূরা কাসাসের ৫৬ নাম্বার আয়াতে যে আল্লাহ বলেছেন তুমি যাকে ভালোবাসো মহব্বত করো তাকে হিদায়াত দিতে পারবে না! আর তুমি অন্ধদেরকে তাদের পথভ্রষ্টতা থেকে হিদায়াত দিতে পারবেনা! সুরা বাকারার ২৭২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, তাদেরকে হিদায়েত করার দায়িত্ব তোমার নয়। সুরা ক্বাফের পঁয়তাল্লিশ ও সুরা ইউনুসের ৯৯ আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, কারো ওপর জোর জবরদস্তি বা বলপ্রয়োগ করা যাবে না। কুরআনের জ্ঞানের মাধ্যমে, কুরআনের আয়াতের মাধ্যমে আপনি শুধু আল্লাহর দিকে দাওয়াত দিতে পারবেন। উপদেশ দিতে পারবেন। সেটা কীভাবে? কোন কৌশলে আপনি দাওয়াত ও উপদেশ দেবেন?

আমরা এখন কুরআন থেকে শিখব। কারণ ২৬ নম্বর সূরা শুয়ারার ২১৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন-

‘’ আর তুমি তোমার নিকটাত্মীয়দেরকে সতর্ক করো’’

এরপর ২১৫, মানে পরের আয়াতে আল্লাহ বলছেন, 

‘’ তুমি তাদের প্রতি বিনয়ী হও।‘’

তারপরের আয়াতে আল্লাহ্‌ বলেছেন,

‘’তারপর যদি তারা তোমার অবাধ্য হয় তাহলে বলো ‘তোমরা যা করো নিশ্চয়ই আমি তা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। তার সঙ্গে আমি সম্পর্কহীন। তার জন্য আমি দায়ী নই।‘’

এর পরের আয়াতে আল্লাহ্‌ বলছেন-

‘’ আর তুমি মহাপরাক্রমশালী পরম দয়ালু আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল কর। নির্ভর করো। ভরসা করো।‘’

তাহলে প্রথম কৌশলটা আমরা শিখলাম। সেটা হচ্ছে আমরা তাদের প্রতি বিনয়ী হবো, নম্র হব, ভদ্র হবো। 

দ্বিতীয় কৌশল সূরা লুকমানের ১৯ নম্বর আয়াতে। লুকমান তার সন্তানকে যখন প্রজ্ঞা শিক্ষা দিচ্ছেন, আল্লাহর হেদায়েতের বাণী শোনাচ্ছেন, কীভাবে ডেকেছিলেন?  ‘’ইয়া বুনাইয়া’’ ওগো আমার প্রিয় পুত্র! এরকম দরদ মাখা সম্বোধন আপনাকে ব্যবহার করতে হবে। ওগো আমার প্রিয় স্ত্রী!  ওগো আমার প্রিয় স্বামী! আমার প্রিয় সন্তান! আমার প্রিয় ভাই! আমার প্রিয় বোন!আমার প্রিয় বাবা! আমার প্রিয় মা! এভাবে দরদ মাখা কণ্ঠে মিষ্টিমধুর উপমা দিয়ে যাকে আপনি দাওয়াত দিবেন তাকে সম্বোধন করবেন।  

১৯ নম্বর আয়াতের আরেকটা কৌশল। এখান থেকে আমরা যা শিখতে পারি সেটা হচ্ছে ‘’তোমার কণ্ঠস্বর নিচু রাখবে’’। অবশ্যই দাওয়াতের সময় আমরা আমাদের কন্ঠস্বর নিচু রাখব। এটি আমাদের তৃতীয় কৌশল। 

চার নম্বর কৌশল: সূরা হুজুরাতের ১১ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ বলছেন—কাউকে কটাক্ষ করো না। কারো দিকে কুরুচিপূর্ণ ইঙ্গিত করা, মন্দ বিশেষণে কাউকে ভূষিত করা—এটা ইসলামে অত্যন্ত গর্হিত অপরাধ।

সূরা হুজুরাত, আয়াত ১১:

“তোমরা একে অন্যের প্রতি দোষারোপ করো না এবং একে অন্যকে মন্দ নামে ডেকো না। ঈমান আনার পর মন্দ নামে ডাকা বা নাম বিকৃত করা অত্যন্ত নিন্দনীয়।‘’

আপনি কাউকে কটু  বা কোনো মন্দ নামে ডাকতে পারবেন না। তার সঙ্গে বিনয়ী হবেন, নিচু কণ্ঠস্বরে কথা বলবেন। আর সেই লোকমানের মতো—“ইয়া বুনাইয়া”, ওগো প্রিয় পুত্র—সেরকমভাবে বলবেন:

ওগো প্রিয় স্ত্রী, ওগো প্রিয় স্বামী, প্রিয় সন্তান, ওগো প্রিয় ভাই—এইভাবে দরদ মাখা কণ্ঠে ডাকবেন। 

দেখুন, সেই ফেরাউন—যে এত নিষ্ঠুর ছিল, এত নৃশংস ছিল—নিষ্পাপ দুধের বাচ্চা শিশুকেও সে জবাই করে মেরে ফেলত। মানুষকে দাস বানিয়ে, গোলাম বানিয়ে রেখেছিল। মানুষকে নির্মম নির্যাতন করতো। এতটা নিষ্ঠুর, নিকৃষ্ট মানুষ—যাকে আল্লাহ দশটি মুজিজা দেখানোর পরও, যে আল্লাহর দিকে ফেরেনি, এত জাহিল, এত বর্বর ছিল—তার কাছেও যখন মূসা (আ.)-কে আল্লাহ পাঠিয়েছিলেন, তখন কী শিখিয়েছিলেন?

সূরা ত্ব‑হা, আয়াত ৪৪‑এ আমরা দেখি, আল্লাহ বলেন—

“তোমরা তার সঙ্গে নম্র ভাষায় কথা বলবে।”

আপনি যাকে আল্লাহর দিকে ডাকবেন, তার সঙ্গে নম্র, ভদ্র ভাষায় কথা বলতে হবে।আপনাকে বিনয়ী হতে হবে। তাকে ব্যঙ্গ করা যাবে না, কটাক্ষ করা যাবে না, এবং আপনার কণ্ঠস্বর নিচু হতে হবে।

সূরা আনকাবূত, আয়াত ৪৬‑এ আল্লাহ শেখাচ্ছেন:

“তোমরা উত্তম পন্থা—মানে সৌজন্য ও চমৎকার যুক্তিপূর্ণ কথা —ছাড়া আহলে কিতাবের সঙ্গে বিতর্ক করবে না।”

মানে, যারা ইহুদি-খ্রিস্টান, তাদের সঙ্গেও উত্তম পন্থায়, মাধুর্য সৌজন্য ও যুক্তি পূর্ণ কথার মাধ্যমে বিতর্ক করতে হবে—এমনই নির্দেশ দিচ্ছেন আল্লাহ। তাহলে যে ব্যক্তি মুসলিম দাবি করে, তার সঙ্গে তো আরও বেশি উত্তম পন্থায়, সৌজন্যপূর্ণ ও সদাচারপূর্ণ বিনয়ী বিনম্র মিষ্টি ভাষায় কথা বলা উচিত—তাই নয় কি?

তো আমরা যখন কোনো বিষয় নিয়ে বিতর্ক করি, আমরা এই বিষয়গুলো ভুলে যাই। আমরা উত্তম পন্থা অবলম্বন করি না। আমরা এগ্রেসিভ হয়ে যাই, আক্রমণাত্মক হয়ে যাই, কণ্ঠস্বর উঁচু হয়ে যায়, নম্রতা থাকে না। অথচ ফিরআউনের মতো নিকৃষ্ট বর্বর মানুষের কাছেও যখন আল্লাহর দাওয়াত নিয়ে যাওয়ার কথা আসে, তখন আল্লাহ শেখাচ্ছেন—“তার সঙ্গে নম্র ভাষায় কথা বলবে।”

এবার আমরা শিখব সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও শেষ কৌশলটি। কারণ, আমাদের পরিবারকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানোর আদেশ আল্লাহই দিয়েছেন। আর সেই আদেশ বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ চেষ্টা ও সাধনা আমাদেরকেই করতে হবে।

সূরা তাহরীম (৬৬ নং সূরা), আয়াত ৬‑এ আল্লাহ বলেন:

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার‑পরিজনকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও।”

এটা আল্লাহর আদেশ। 

তারপর আল্লাহ আমাদের সেই সর্বশেষ কৌশল ও পদ্ধতি শেখাচ্ছেন।

সূরা নাহল (১৬ নং সূরা), আয়াত ১২৫‑এ আল্লাহ বলেন:

“তুমি মানুষকে তোমার রবের পথে দাওয়াত দাও—আহ্বান করো হিকমত মানে জ্ঞান বুদ্ধি, প্রজ্ঞা আর সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে, উত্তম উপদেশের মাধ্যমে। সৎ উপদেশের মাধ্যমে এবং তাদের সাথে বিতর্ক করো সুন্দরতম পন্থায়, চমৎকার পদ্ধতিতে।‘’

This is the best কৌশল, যেটা কুরআনে আল্লাহ শিখিয়েছেন—যখন আমরা কারো সঙ্গে ডিবেট বা বিতর্ক করব, সেটা যেন হয় সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে মাধুর্যময়, সবচেয়ে চমৎকার পন্থায়। আমরা সেটা করব সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে, চমৎকার ভাষায়, আর হিকমতের মাধ্যমে, প্রজ্ঞার মাধ্যমে।

অনেক সময় আমরা ‘জ্ঞান’ আর ‘প্রজ্ঞা’ গুলিয়ে ফেলি।

জ্ঞান কী?

কোনো কিছু জানা, কোনো ইনফরমেশন কালেক্ট করা কোন তথ্য সংগ্রহ করা মানে জ্ঞান। আপনি নয়ের ঘরের নামতা জানেন—এটা জ্ঞান। আপনি সরল অঙ্ক জানেন—জ্ঞান। আপনি যোগ‑বিয়োগ জানেন—এটা জ্ঞান।আপনি আমেরিকার প্রেসিডেন্টের নাম জানেন— এটা জ্ঞান।

তাহলে প্রজ্ঞা কী?

ধরুন আপনি গ্রামে গেলেন। দেখলেন—বর্ষাকাল, বিলে পানি জমেছে। কোথাও চার আঙুল পানি, কোথাও এক বিঘত, কোথাও হাঁটু সমান, কোথাও গলা পর্যন্ত পানি।দুই বন্ধু, কলেজ বা ইউনিভার্সিটি ছুটির পর গ্রামে যাচ্ছেন। পথে এই রকম পরিস্থিতি এলো। আপনারা ভাবলেন, “সারা জীবন তো এত গণিত শিখেছি—আজ একটু লাইফে এপ্লাই করি দেখি!বাস্তব জীবনে হাতে-কলমে প্রয়োগ করে দেখি!” তখন একটা ছোট কাঠি বা লাঠি দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় পানির গভীরতা মেপে গড় হিসেব বের করলেন। ধরুন গড় দাঁড়াল—হাঁটু পর্যন্ত পানি। এখন যদি আপনি প্যান্ট হাঁটু পর্যন্ত তুলে নেন আর রওনা দেন—আপনি কি পার হতে পারবেন? পারবেন না। কারণ যেখানে মাথার উপরে পানি—সেরকম জায়গায় যখন যাবেন, তখন ঠিকই ডুবে যাবেন, পুরো শরীর ভিজে যাবে। সুতরাং এই গল্প থেকে পরিষ্কার বুঝলেন যে স্কুল‑কলেজে আপনি যে গড় অঙ্ক শিখেছেন, সেটি আপনি প্রজ্ঞার সাথে জীবনে প্রয়োগ করতে পারেননি।

পরিস্থিতি অনুযায়ী বুদ্ধিমত্তা ও কৌশল প্রয়োগই হচ্ছে প্রজ্ঞা।

আপনি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলেন, ডাক্তারি শিখলেন। কিন্তু শুধু থিওরিটিক্যাল বই পুস্তকের জ্ঞান শিখলেই তো হবে না। এমনভাবে শিখতে হবে, যাতে করে একদিন আপনি নিজের হাতে একজন ইমার্জেন্সি রোগীর সার্জারি করতে পারেন। সেই প্রজ্ঞাটা যখন আপনার মধ্যে অর্জিত হবে, তখনই আপনি একজন পারফেক্ট ডাক্তার হতে পারবেন।

অর্জিত জ্ঞান, কৌশল, এবং বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে যে প্রয়োগক্ষমতা আসে—সেই ইন্টেলিজেন্সকে বুদ্ধি মত্তাকেই বলা হয় প্রজ্ঞা।

একজন হাফেজ যদি কুরআনের সব আয়াত মুখস্থ করেন, তাতে তার প্রজ্ঞা আছে কি না—সে প্রশ্ন প্রশ্ন থেকেই যায়। কারন শুধু মুখস্থ করলেই প্রজ্ঞা আসেনা, যেটা আসে তা তথ্য বা জ্ঞান।

যখন আপনি আপনার পরিবার, আত্মীয়-স্বজনদের আল্লাহর দিকে ডাকবেন, দাওয়াত দিবেন কুরআনের আলোকে, তখন আপনাকে এই হিকমত এই প্রজ্ঞা প্রয়োগ করতে হবে। সুন্দর উপদেশ, সৌজন্যময় বিতর্ক,মাধুরি মিশ্রিত কথা এবং সর্বোত্তম পন্থা—এই হলো কুরআনের শেখানো কৌশল।

তাহলে আমরা সবগুলো কৌশল শিখলাম। এই কৌশলগুলো অবলম্বন করে আমরা আমাদের প্রিয়জনকে আল্লাহর দিকে, ইসলামের দিকে, জান্নাতের দিকে ডাকব।

সংক্ষেপে আমরা যা শিখলাম তা হলো:

🔹 সূরা বায়্যিনাহ তে বলা হয়েছে:

যারা ঈমান আনে ও কর্মকে সংশোধন করে, সৎকর্ম করে, তারা সৃষ্টি জগতের মধ্যে সর্বোত্তম।

🔹 সূরা ফুসসিলাত (আয়াত ৩৩)-এ বলা হয়েছে:

“সেই ব্যক্তির কথার চেয়ে উত্তম কারও কথা হতে পারে না—যিনি মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকেন, নিজের কর্মকে সংশোধন করেন, সৎ কাজ করেন, এবং বলেন—আমি মুসলিমদের একজন।”

🔹 সূরা আন‑নামল (আয়াত ৯১-৯২)-এ রাসূল বলেন:

“আল্লাহ আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন—আমি যেন মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত হই এবং কুরআন অধ্যয়ন করি।”

আপনি যখন কুরআন অধ্যয়ন করবেন, তখন দেখবেন:

🔸 সূরা তাহরীম (৬৬:৬)-এ আল্লাহ বলেন:

“হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবারকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও।”

🔸 সূরা আশ‑শুআরা (২৬:২১৪)-এ আল্লাহ বলেন:

“তুমি তোমার নিকট আত্মীয়দেরকে সতর্ক করো।”

এই দুটি আয়াতের আলোকে আপনি আপনার পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনকে সতর্ক করতে চাইছেন।

আর আপনি জানেন, সবচেয়ে বড় জিহাদ বা জিহাদে আকবর হলো—এই কুরআন প্রচার করা, কুরআনের মাধ্যমে উপদেশ দেয়া।

সূরা কাফ (৫০:৪৫)-এ আল্লাহ তাঁর রাসূলকে বলেন যে তুমি কুরআনের মাধ্যমে  উপদেশ দাও, কিন্তু কারো উপর জোর জবরদস্তি করো না।

তাই কুরআনের সাহায্যে, সুন্দর মাধুয্যময়  উপদেশের মাধ্যমে, আমরা কিভাবে আমাদের পরিবার, প্রিয়জন এবং আত্মীয়দেরকে আল্লাহর পথে ডাকব—সেদিকেই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।

কিন্তু এখানে একটা ভুল আমরা প্রায়ই করি—আমরা নিজের পরিচয় দেই: আহলে হাদীস, আহলে কুরআন, শিয়া, সুন্নি, তাবলিগি, মাযহাবী, হিজবুত… ইত্যাদি নামে। এটা কুরআন‑বিরোধী কৌশল। কুরআন অনুযায়ী কৌশল হলো—নিজেকে “মুসলিম” হিসেবে পরিচয় দেয়া। সূরা আন‑নামল (৯১-৯২)-এ রাসূল নিজেকে মুসলিম বলেই পরিচয় দিতেন। কখনো কোনো ফিরকা বা দলীয় নামে নয়।

এরপর আমরা দেখেছি:

🔹 সূরা আশ‑শুআরা (২৬:২১৫–২১৯):

পরিবার‑পরিজনের প্রতি বিনয়ী হতে হবে।

🔹 সূরা লুকমান:

কণ্ঠস্বর নিচু রাখতে হবে।

🔹 সূরা হুজুরাত (১১):

কাউকে কটাক্ষ করা যাবে না, দোষারোপ করা যাবে না।

এভাবেই কটাক্ষ না করে, দোষারোপ না করে, নিচু কণ্ঠে, বিনয়ের সঙ্গে, নম্রভাবে এগিয়ে যেতে হবে।

যেমন—সূরা তোহা (২০:৪৪)-এ আমরা দেখি:

“তোমরা ফিরআউনের সঙ্গে নম্র ভাষায় কথা বলবে।”

অথচ সে ছিল ইতিহাসের এক নৃশংস, বর্বর, নিষ্ঠুর শাসক। এমন একজনের ক্ষেত্রেও আল্লাহ বলেন:

“নম্রভাবে কথা বলো।”

🔸 সূরা আনকাবুত (২৯:৪৬)-এ বলা হয়েছে:

“তোমরা আহলে কিতাবদের সঙ্গে বিতর্ক করবে না—অত উত্তম পন্থা ও যুক্তিপূর্ণ পদ্ধতি ছাড়া।”

এমনকি ইহুদি, খ্রিস্টানদের সঙ্গেও যদি বিতর্ক হয়, তাহলেও আক্রমণাত্মক ভাষা ব্যবহার করা যাবে না।

যদি আপনি মনে করেন, আমি এগ্রেসিভ, আক্রমণাত্মকভাবে কাউকে কুরআনে দীক্ষিত করব—তাহলে আপনার জন্য বিতর্ক করা তো দূরের থাক, কথা বলতে যাওয়াই নিষিদ্ধ। 

মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে আজকে শেখা কৌশলগুলো নিজের ব্যক্তিগত জীবনে, পারিবারিক জীবনে, এবং সামাজিক জীবনে বাস্তবায়ন করার তৌফিক দান করুন।

আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল ‘আলামিন।

রিজওয়ান মাহমুদ খান ‑পরিচালক ( তাজকিয়া নফস ডট কম)

4 thoughts on “পরিবারে এবং আত্মীয়স্বজনের মধ্যে কুরআনের দাওয়াত দেয়ার ৫টি কৌশল?

  1. ‘আল্লাহ্‌র রাসূল তাঁর চাচা আবু তালেবকেও হেদায়াত দিতে পারেননি। এই দায়িত্ব আমার বা আপনার কারোই নয়’ প্রিয় রিজওয়ান ভাই এই উদাহরণটি আপনি হাদিস থেকে দিয়েছেন, যেহেতু আপনাদের এই প্লাটফর্মটি অনলি কোরআন সেই ক্ষেত্রে এই উদাহরণটি উল্লেখ না করাই শ্রেয়, মাশাআল্লাহু লা কুয়াতা ইল্লা বিল্লাহ…

  2. “লেখাটা পড়ে খুব ভালো লাগলো। অনেক নতুন কিছু জানতে পারলাম, ধন্যবাদ!”
    “অসাধারণ লিখেছেন! এই বিষয়টা নিয়ে এত সুন্দরভাবে আগে কখনো ভাবিনি।”

  3. আলহামদুলিল্লাহ, রিজওয়ান ভাই, আপনার তাজকিয়া নফস ওয়েব সাইটটি মুসলিমদের নবজাগরণের এক অনন্য প্লাটফর্ম। আল্লাহ তায়ালা আপনাকে সর্বোত্তম সাহায্য করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *