অভিশপ্ত শয়তান থেকে মহান আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাই। সকল প্রশংসা সমগ্র বিশ্বের প্রতিপালক মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের জন্য।
আজকের বিষয় কোরআন না বোঝার কারণ কি? আসলে কুরআন না বোঝার অসংখ্য কারন আছে। তবে মূলত পাঁচটা কারণ এর জন্য দায়ীঃ
প্রথম কারণ: আরবি ভাষা না জানা। (অনুবাদ এর উপর অতি নির্ভরশীলতা)
কুরআনের ভাষা আরবী। একেবারে বেসিক লেভেলে কুরআনকে বুঝতে গেলেও কিছুটা আরবী জানা প্রয়োজন। এজন্যতো আগে অন্তত মানুষের মাঝে এর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। আর সচেতনতা তৈরি করা, মূল্যবোধ সৃষ্টি করার দায়িত্ব সব সময় ন্যাস্ত থাকে সমাজের বিদ্বান ও আলেমদের উপর। হুজুর, স্কলার, মুফতি, মৌল্ভি, পাদ্রি, যাজকদের উপর। তবে যারা আরবের হুজুর‑আলেম‑মোল্লা ছিলেন বা আছেন তাদের প্রায় শতভাগই নিজ দেশের রাজা-বাদশাহদের শৃঙ্খলিত কৃতদাস। তারা শুধুই তাদের পৃষ্ঠপোষকদের কিসে সুবিধা অসুবিধা হবে সেই দিকেই লক্ষ্য রেখেছেন। রাজা-জমিদার‑খলিফা-আমিরদের ইচ্ছা-অনিচ্ছাই ছিল হুকুম। স্রষ্টার প্রেরিত ঐশী কিতাব আর সেই কিতাবের বিধি নিষেধ নয়। আর রাজা বাদশাহরাও তাদের বাদশাহী রক্ষায় মানবরচিত শরীয়তের নামাজ রোজা হজ যাকাত ইত্যাদিকেই উপযোগী বলে মনে করেছেন, অবশ্য পালনীয় বলে হুকুম দিয়েছেন। এসবের বাইরে গিয়ে কোরআন অধ্যয়ন কিংবা গবেষণায় তাদের তিল পরিমাণও আগ্রহ ছিলনা, ইচ্ছাও ছিলনা, ছিলনা প্রয়োজনও। কারণ তাতে তাদের সাম্রাজ্যের বিস্তারে বা স্থায়িত্ব রক্ষায় কোন উপকার করে নি। বরং ক্ষমতা ও সিংহাসন হারাবার ভয় ছিল, ঝুঁকি ছিল । ছিল জাঁকজমকপূর্ণ ভোগ‑বিলাস হারাবার শঙ্কাও। সত্যের নূর মানুষের চোখে স্পষ্ট হয়ে গেলে তাদের মুখোশ খুলে যেত। শাসনের নামে শোষণ ও দুর্নীতির যে রাজ্য তারা গড়ে তুলেছিল তা ধ্বসে পড়ত। আর তাই তাদের দরবারি আলেমদের রচিত পাঁচ খুঁটি বা পঞ্চ স্তম্ভ বাস্তবায়নই ছিল তাদের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ মিশন। তাইতো দরবারি আলেমদের সহযোগিতায় কুরআন ধরলেই সওয়াব, তিলয়াত করলেই সওয়াব, মুখস্ত করলেই সওয়াব, খতম দিলেই চলবে, ঘরে সাজিয়ে রাখলেই নেকী, একবার সূরা ইখলাস পড়লেই পুরো কুরআন পড়ার নেকী নিশ্চিত – ইত্যাদি ইত্যাদি অপপ্রচারে তাদের ছিল অতি উৎসাহ। এসব অপপ্রচার প্রতিষ্ঠা করে আরামপ্রিয় সাধারণ মানুষের আস্থা বিশ্বাস ও ভক্তি অর্জন করতে পেরেছেনও পুরোপুরি। কুরআন বোঝার কোন প্রয়োজন যেহেতু নেই, তাই কুরআন যে ভাষায়, সেই ভাষা শেখারও কোন প্রয়োজন নেই। দরকার হলে পুরো কুরআন মুখস্ত করে হাফেজ হতে হবে তবুও আরবী শেখার কোন প্রয়োজনীয়তা নেই। কারন কুরআন তো বোঝার জিনিসই নয়! শুধুই না বুঝে মুখস্ত আর তিলাওয়াত করার জিনিস। আর তাই যুগে যুগে আলেমগন মানুষকে এটা বিশ্বাস করাতে সক্ষম হয়েছেন যে আরবী ভাষা না জানলেও কোনই সমস্যা নেই। এ জন্য তারা কাউকে উৎসাহিতও করেন নি, সাহায্যও করেননি। যেহেতু একটি গ্রন্থ অধ্যয়ন করতে অন্তত প্রথম ধাপে সেই গ্রন্থের যে ভাষা সেটা জানা প্রয়োজন, কুরআনের ক্ষেত্রে সেটা ঘটতে পারেনি। হয়তো পৃথিবীতে কুরআনই একমাত্র গ্রন্থ যা বোঝার উদ্দেশ্যে পাঠ করার প্রয়োজন হয় না, শেখার উদ্দেশ্য মনোনিবেশ করতে হয় না, শুধু মাখরাজ আর উচ্চারন ঠিক রেখে টেনে টেনে আউরে গেলেই চলে। আর তাই কুরআনকে অন্তত শব্দে শব্দে বেসিক অর্থটুকু বুঝেও পড়া হয়না। তার জন্য যতটুকু আরবী জানা প্রয়োজন সেইটুকু জানার প্রয়োজনীয়তাও সাধারন মানুষকে বোঝানো হয়নি।
একটি বই পড়তে গেলে আপনি যদি বইটি যে ভাষায় লেখা হয়েছে সেই ভাষাটাই না জানেন তাহলে আপনাকে যে অবশ্যম্ভাবী ভোগান্তির শিকার হতে হবে তা হল একেবারে পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়তে হবে এর অনুবাদ এর উপর। অনুবাদকারীর হাতে আপনি একেবারে তুলে দেবেন নিজেকে। আর যেহেতু আপনি ভাষাটি একেবারেই জানেন না, অনুবাদ যদি কোন কারনে ভুল থাকে আপনার কিছুই করার থাকবে না। আপনি বুঝতেও পারবেন না এমন ভুল বা বিকৃতি কোথায় কোথায় করে রাখা আছে। আর এমন অবস্থায় ভুল অনুবাদের শিকার হয়ে ঐ বইটিকেও ভুল বোঝার সম্ভাবনা একেবারে শতভাগ। তাই কুরআন না বোঝার পরবর্তী কারন হচ্ছে কুরআনের ভুল অনুবাদ এবং কিভাবে তা নানাভাবে কুরআন বোঝার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে।
দ্বিতীয় কারনঃ ধর্মের রক্ষকদের ভক্ষকের ভুমিকা পালন। (কুরআনের ভুল অনুবাদ, সুবিধামত অর্থের বিকৃতি, মনমতো তথ্য ও তত্ত্বের সংযোজন‑বিয়োজন)
কুরআনের আবির্ভাবের পর থেকে গত ১৪০০ বছরে যতো অনুবাদকারী এসেছেন এদের প্রায় সকলেই ছিলেন কোন না কোন ভাবে ক্ষমতাবানদের দ্বারা প্রভাবিত। কখনো রাজনৈতিক, কখনো অর্থনৈতিক, কখনো দলগত ও সামাজিক ইস্যু দ্বারা তাড়িত হয়েই তারা কুরআনের অনুবাদ করতে বসেছেন। আর একজন অনুবাদকারীর উদ্দেশ্যই যখন থাকবে একটি মানব তাড়িত অ্যাজেনডা বাস্তবায়নে সহায়তা করা বা পার্থিব স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্য সেটা করা , যা অনুবাদ করা হচ্ছে তার আসল অর্থ উদ্ধারের চেষ্টা করা নয়, তখন তো সেই অনুবাদ কখনোই সঠিক হবে না। কখনো এতে ঠাই পাবে ভুল শব্দার্থ আবার কখনো সুবিধামত ইচ্ছাকৃত বিকৃতি। এরপর আবার আছে কুরআনের আয়াতের ব্যাখ্যার নামে চালিয়ে দেয়া অজস্র অপব্যাখা। যারা ধর্মের জাজক-আলেম‑বিদ্বান‑নেতা-আমির তারাই যখন কুরআনের সঠিক অর্থ মানুষের কাছে যাতে না পৌঁছায় সেই চেষ্টায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তখন মানুষ কুরআন পড়লেও কুরআনের সত্যটা অনুধাবন করতে পারবে না এটাই স্বাভাবিক।
একটু মনযোগ দিয়ে লক্ষ্য করলেই বোঝা যায় যে আমাদের কুরআন অনুবাদকারীগণ সুকৌশলে কোরআনের অনুবাদে গুরুত্বপূর্ণ অসংখ্য আরবি শব্দের সরাসরি বাংলায় অনুবাদ না করে হুবহু আরবি অথবা উর্দু হিন্দি ফার্সি শব্দ রেখে দিয়েছেন। অথচ তারাই কুরআনের অন্যান্য আয়াতের জায়গায় হুবহু আরবী শব্দ না রেখে সরাসরি বাংলা শব্দ দিয়েই অনুবাদ করেছেন। অর্থাৎ যখন যেটা প্রয়োজন, সেই অনুসারে পরিবর্তন, সংযোজন, বিয়োজন। একটি উদাহরন দেখতে চান?
সূরা জাথিয়া, আয়াত ৬ঃ
এগুলো আল্লাহর আয়াত যা সত্যতা সহকারে তোমার কাছে তিলাওয়াত করা হচ্ছে। এরপর তারা আল্লাহ এবং তাঁর আয়াতের পর আর কোন্ হাদিসে বিশ্বাস করবে?
মজার ব্যাপার হচ্ছে কোন এক রহস্যময় কারনে অনুবাদকারীরা এই আয়াতের শব্দার্থ করতে গিয়ে সবসময় ‘হাদিস’ শব্দটির জন্য অর্থ লিখে থাকেন ‘’কথা বা বাণী’’। অর্থাৎ তাঁরা এই বাক্যটিকে এভাবে লেখেনঃ
এগুলো আল্লাহর আয়াত যা সত্যতা সহকারে তোমার কাছে তিলাওয়াত করা হচ্ছে। এরপর তারা আল্লাহ এবং তাঁর আয়াতের পর আর কোন্ কথায় বিশ্বাস করবে?
কারন আল্লাহ্র আয়াত ছাড়া অন্য কোন ‘হাদিসে’ (তথাকথিত বুখারি, মুসলিম ইত্যাদি নবীর নামে চালিয়ে দেয়া মানব রচিত হাদিস) যে বিশ্বাস করা চলবে না এটা জনসমক্ষে তাঁরা প্রকাশ করতে বড়োই অনিচ্ছুক। তাই ইচ্ছে করেই তাঁরা এখানে ‘’হাদিস’’ শব্দটিকে হুবহু ‘’হাদিস’’ নামে না রেখে এর বাংলা অর্থ করেন কথা/বানী। অথচ এই একই মানুষেরা অন্যান্য স্থানে ‘’যাকাতের’’ অর্থ ‘’পরিশুদ্ধতা’’ লিখতে চান না। যাকাত কে হুবহু যাকাতই লিখে দেন। রুকু অর্থ বিনয়াবনত লেখেন না। তাঁরা এটা বলেন না –
তোমরা বিনয়ীদের সাথে বিনয়ী হও।
বরং তাঁরা লিখে থাকেন তোমরা রুকুকারীদের সাথে রুকু কর। এভাবেইতাঁরা মানুষকে কোমর বাকিয়ে ঝুঁকে পড়াকেই একমাত্র রুকু করা বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন। কিংবা মাটিতে কপাল ঠেকানোই ‘’সিজদা’’ এই ভুল তথ্যটিও মানুষের মনে একেবারে কঠিন পেরেকের মতো করে গেঁথে দিয়েছেন। একই ঘটনা সালাত এর ক্ষেত্রেও। কই কোন অনুবাদকারীতো সালাতের জন্য এর বাংলা অর্থ সংযোগ বা মিলন লেখেন না! তখন সবাই সালাত কে হুবহু ‘’সালাত’’ রেখেই অনুবাদ করেনঃ
তোমরা সালাত কায়েম কর/সালাত প্রতিষ্ঠা কর।
কেউ লিখতে চান না তোমরা সংযোগ প্রতিষ্ঠা কর।
আবার কখনো কখনো সালাতের জায়গায় তাঁরা অতি উৎসাহে ‘’নামাজ কায়েম কর’’ লিখে থাকেন যেটা কি না একটি ফার্সি শব্দ। কারন সালাতের অর্থ ‘’নামাজ বা সালাত’’ লিখলেই তো তখন সেই মানবরচিত ওঠা-বসা করা, শারীরিক কসরতে পরিপূর্ণ নামাজ প্রতিষ্ঠা করতে তাদের জন্য সুবিধা হবে। এক্ষেত্রে সালাত শব্দটির আভিধানিক অর্থ ‘’সংযোগ’’ করলে সেটা তাদের শারীরিক নামাজ এর বিরুদ্ধে চলে যাবে তাই না? কিন্তু নামাজ কথাটা বললেই ‘’প্রচলিত নামাজ কুরআনে আছে’’ এই কথাটা বলতে বড়োই সুবিধা হয়। কারন প্রচলিত একটি নামাজ এর অস্তিত্ব কুরআনের বাইরে আসলেই আছে। ঐ নামাজই যে কুরআনের সালাত এটা প্রমান করাটাই তাদের মিশন। তাই নামাজের ক্ষেত্রে অবশ্যই সালাত কে মিলন/সংযোগ না বলে নামাজ বলা চাই! আল্লাহ্র সাথে সংযোগ বা সত্যের সাথে সংযোগ স্থাপিত হলে মিথ্যের সাম্রাজ্য টিকবে কি করে?
আবার এই একই মানুষেরা যখন আল্লাহ্ তাদের উপর সালাত করেন এমন আয়াত পান, তখন তাঁরা সালাতের অর্থ নামাযও লেখেন না আবার সেটার বাংলা অর্থও করেন না। তখন তাঁরা সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি শব্দ ভৌতিক ভাবে এনে জুড়ে দেন। তখন সালাত হয়ে যায় ‘’রহমত বা দয়া’’! অথবা সূরা আল হাজ্জের আয়াত চল্লিশে সালাত শব্দটি হঠাৎই ভৌতিক ভাবে হয়ে যায় ইহুদিদের উপাসনালয়! কি আশ্চর্য চমৎকার তাদের এই দ্বিচারিতা! তাদের বানানো নামাজই কুরআনের নামাজ এটা প্রতিষ্ঠা করতে যখন যেভাবে খুশি তখন সেভাবে শব্দের অর্থের বিকৃতি ও পরিবর্তন করতে তাদের বিন্দুমাত্র দ্বিধা-সংকোচ নেই! মাঝখান থেকে সাধারন মানুষের নিদারুন ভোগান্তি। একেই তো আরবী তাদের মাতৃভাষা নয়, তাই বেশিরভাগ মানুষ শব্দার্থ নিয়ে গবেষণা পর্যন্ত আসতেই পারে না। এরপর অল্পসংখ্যক যে কয়জন এই পর্যন্ত আসতে পেরেছেন তাঁরাও এবার অনুবাদের এই পাকে পড়ে একেবারে দিশেহারা! হাদিস‑ফিকাহ‑মাসালা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আলেমগন এলোমেলো ভাবে কুরআন এর অনুবাদ করেছেন। সাধারন মানুষ এই অনুবাদ বিভ্রাটের চোরাবালিতে পড়ে শুধুই কুরআনের সত্য থেকে আরও দূরে সরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন।
ভুল ও মিথ্যার যে বীজ আমাদের মাননীয় আলেমরা বপন করেছিলেন, হাজার বছরে তার শিকর গজিয়েছে মানুষের মনের অনেক গভীরে। ডালপালা, শাখা-প্রশাখা ছড়িয়েছে অনেক দূর‑দূরান্ত পর্যন্ত। আজ তাই চাইলেও সম্ভব নয় হাজার বছরের এই মিথ্যা ও ভুলের শিকর ও শিকল থেকে খুব সহজে এবং দ্রুত মুক্ত হওয়া। এই আলেম নামধারী কপিবাজ অনুবাদকারীরা তাঁদের বিখ্যাত কপি-পেস্ট পদ্ধতির ব্যবহার করে কখনো ফার্সি থেকে উর্দুতে আবার কখনো উর্দু থেকে বাংলায় কপি অনুবাদ করে গেছেন। কিন্তু কুরআনের যে অরিজিনাল আরবী তার প্রকৃত অর্থের কাছে পৌঁছানো নিয়ে তাঁদের মাথা ব্যাথা নেই। তাই কুরআনের যে অন্তরনিহিত সৌন্দর্য, দর্শন, ভাব ও আধ্যাত্মিকতা তা এই কপি-পেস্ট শিল্পের ক্যানভাসে স্থান পায়নি। আর সাধারন মানুষও পাননি এর সন্ধান। অপরদিকে কুরআন বলছে –
তারা কি কুরআন সম্বন্ধে গভীরভাবে চিন্তা করে না, না তাদের অন্তর তালাবদ্ধ? (সূরা ৪৭, আয়াত ২৪)
কুরআনের এই আয়াত অনুযায়ী কপি-পেস্ট চর্চা নিষিদ্ধ। আর গভীর চিন্তা-ধ্যানকে করা হয়েছে উৎসাহিত। কুরআন অনুবাদকারীরাতো কুরআন থেকে শিক্ষা কখনোই নেন নি। আর গভীর ধ্যানও করেন নি কুরআনের আয়াতসমূহ নিয়ে।
আরবী ভাষা না জানা এবং অনুবাদের উপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা এবং তার ফলস্বরূপ অনুবাদ বিভ্রাট এর শিকার হয়ে কুরআনকে ভুল বোঝার পর আসে পরবর্তী সমস্যাটি। কুরআনের ভাবার্থ না বুঝতে পারা। তাই আমাদের পরবর্তী কারন হিসেবে এর বিশদ আলোচনা করা হয়েছে।
তৃতীয় কারনঃ কুরআনের ভাবার্থ, মর্মার্থ, দর্শন, শৈল্পিক সৌন্দর্য না বুঝতে পারা।
কুরআন কাব্য নয় কিন্তু কাব্যিক, অর্থাৎ এটি শুধুমাত্র কাব্যগ্রন্থ নয়, কিন্তু ঐশীগ্রন্থ এই কুরআনে অবশ্যই রয়েছে এক স্বর্গীয় কাব্যের ছোঁয়া। কুরআন শুধুমাত্র দর্শন‑গ্রন্থ নয় কিন্তু এটি অনস্বীকার্য যে কুরআনে আছে গভীরতম দর্শনের নিগূঢ়তত্ত্ব। কুরআন কোন প্রেমগ্রন্থে সীমাবদ্ধ নয়, কিন্তু নিঃসন্দেহে এটি মহামহিম স্রষ্টার পক্ষ থেকে মানবহৃদয়ের জন্য প্রেমপত্র। কুরআনের এই ভাবগত, দর্শনের, সৌন্দর্যের, গভীর ও আধ্যাত্মিকতার দিকটি বাদ দিয়ে কুরআনকে কখনোই সর্বাঙ্গীণভাবে অনুধাবন করা সম্ভব নয়। কারন এই কুরআন তো সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম সাহিত্যকর্মও (Surah Az-Zumar – 39:23 পরম উত্তম/ পরম সুন্দর বাণী — أَحْسَنَ ٱلْحَدِيثِ)। যেকোন সাহিত্যকর্মের, যেকোন ভাষার ভাব প্রকাশের প্রধানত তিনটা মাধ্যম থাকে। এক – গদ্য, মানে প্রবন্ধ,নিবন্ধ,আখ্যান,গল্প, উপন্যাস ইত্যাদি। দুই ‑পদ্য, মানে কাব্য, ছন্দ, ছড়া বা কবিতা। আর তিন‑গান, মানে গীত‑সঙ্গীত, বা সুর‑লহরী।
এবারে, উপরে উল্লেখিত তিনটি মাধ্যম সম্পর্কে সামান্য আলোকপাত করা যেতে পারে। পাঠকের মনে এমন প্রশ্ন জাগতে পারে গদ্য কি? গদ্য হচ্ছে ‑কথা বাণী বা বক্তৃতা যা পুরোপুরি শাব্দিক বা আভিধানিক বা ডিকশনারীর অর্থের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। আর পদ্য বা কাব্য, ছন্দ, ছড়া বা কবিতা কি? যার প্রত্যেকটি পদে পদে ও ছন্দে ছন্দে আংশিক আভিধানিক আর আংশিক ভাব‑অর্থের সংমিশ্রণ থাকে। এর অবশ্য অনেক শাখাপ্রশাখা রয়েছে। তিন- গান, গীত, সঙ্গীত, সুরলহরী হচ্ছে – ছন্দ- ছন্দচ্যুতি, ভাব, গদ্য বা পদ্যকে যখন তান, তাল, লয়, নাদ, রাগ, মূর্ছনা সুর বা লহরির মাধ্যমে প্রকাশ করা হয় তখন সেটাই গানের রূপান্তর।
অর্থাৎ একই বিষয়ে মনের ভাব কথার মাধ্যমে প্রকাশকে বলে গদ্য; ছন্দ ও কথার সংমিশ্রণের মাধ্যমে প্রকাশকে বলে পদ্য আর কথা, কাব্য, ভাব ও সুরের সংসংমিশ্রণের মাধ্যমে একটি সর্বাঙ্গসুন্দর প্রকাশকে বলে গান । তবে গানের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো কাব্য বা ভাববাদ। আর এটি আভিধানিক অর্থের সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত, পরিপূর্ণ এবং প্রজ্ঞাময়।
আমাদের মানব শরীরও এরকম তিন ভাগে বিভক্ত। গদ্য, পদ্য, গান। স্বাভাবিকভাবে বাহ্যিক দেহ হলো গদ্য। দেহের অঙ্গ, পোশাক, বাহ্যিক সৌষ্ঠব, অলংকার হলো পদ্য বা কবিতা। আর সবকিছুর ভারসাম্যপূর্ণ উপস্থাপন, কথা-বার্তা-চলাফেরার পরিপূর্ণ মাধুর্য্যের সমন্বয় হলো গান বা সুর লহরী।
এবারে নফস — আত্মা, সত্তা, মন। আমাদের যে নফস আছে সেই নফসেরও আবার একইভাবে তিনটা প্রকার আছে। নফসে লাউয়ামা, নফসে মুতমাইন্না, নফসে আম্মারা। সূরা ইউসুফের ৫৩ নাম্বার আয়াতে গেলে আপনি পাবেন নফসে লাউয়ামা। সূরা কিয়ামাহর দুই নাম্বার আয়াতে গেলে পাবেন নফসে আম্মারা। সূরা ফজরের ২৭থেকে ৩০ আয়াতে গেলে পাওয়া যায় নফসে মুতমাইন্না। (এই নফস সম্পর্কে আরও বিস্তারিতভাবে আলোচনা করে ভিডিও আপলোড করা হয়েছে।)
নফসের মধ্যে থাকে মানুষের জ্ঞান, বুদ্ধি-বিবেক, আকল। আর নফসটাকে খুব চমৎকারভাবে আল্লাহ ব্যালেন্স করে দিয়েছেন। সূরা শামসের সাত, আট ও নয় নম্বর আয়াত পড়লে আপনি খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করবেন। “কসম নফসের, আর সেই সত্তার যিনি তাকে ব্যালেন্স করেছেন- সুষম করেছেন ‑সুসামঞ্জস্যপূর্ণ্য করেছেন। অতঃপর তিনি তাকে অবহিত করেছেন তার পাপসমূহ ও তার তাকওয়া সম্পর্কে’’ -মানে তাকে সৎকর্ম, অসৎকর্মের জ্ঞান দান করেছেন। দান করেছেন পাপ‑পুণ্যের জ্ঞান (আল্লাহ অটোমেটিক্যালি/স্বয়ংক্রিয়ভাবেই তা মানুষের মধ্যে দিয়ে দিয়েছেন)
এরপর তৃতীয় যে বিষয় সেটাই হচ্ছে নূর- আলো বা জ্যোতি। ইংরেজিতে একে বলে ‘Enlightenment’, পরম চেতনার উন্নতি, আত্মার সর্বোত্তম বিকাশ। আল্লাহর নূর ও মুত্তাকীর ভিডিওটা যারা দেখেছেন তারা বোঝেন যে খাঁটি মুমিন বা মুত্তাকী হলেই আল্লাহ তাদেরকে এই নূর দান করেন। রাব্বুনাল্লাহ এর উপর অটল থাকলে রাব্বুল আলামিন তাদের প্রতি ফেরেশতা নাযিল করেন। আখিরাতে তারা সেই নূর প্রাপ্ত হয়ে আল্লাহর স্পেশাল গেস্ট বা বিশেষ মেহমান হিসেবে হাশরের মাঠে উপস্থিত হবেন। আর এই নূর কিভাবে অর্জন করতে হয়? বেস্ট পদ্ধতি হচ্ছে মুমিন‑মুত্তাকী হওয়া । সুরা হাদিদের ১৩,১৪,১৫ আয়াত পড়লে পাওয়া যায় এই নুরের সন্ধান।
উপরে আলোচিত সাহিত্য, মানবদেহ ও নফসের মতই কুরআনও এরকম তিনটা স্তরে বিভক্ত – গদ্য, পদ্য আর সুর‑লহরী। এই তিনটি স্তরের সঠিক প্রয়োগ ও অনুধাবনের মাধ্যমেই কুরআনকে সঠিকভাবে এবং পূর্বের চেয়েও আরও গভীরভাবে অনুধাবন করা সম্ভব।
- কুরআনের গদ্য – ইতিপূর্বে আলোচিত গদ্যের মতোই কুরআনের গদ্য হচ্ছে এর সবচেয়ে উপরের বা দৃশ্যমান সাধারন স্তর। এটি হচ্ছে সেই দেহের মতো। এটি হল কুরআনের শাব্দিক বা আভিধানিক স্তর। এই স্তরেই শব্দে শব্দে অর্থের মাধ্যমে সবচেয়ে বেসিক বা সাধারন জ্ঞানটুকু কুরআন থেকে অর্জিত হয়। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে এই সাধারন স্তরে পৌঁছানোই বেশিরভাগ মানুষের কাছে বড় দুঃসাধ্য। এই স্তরে উত্তীর্ণ হতেই আপনাকে পোড়াতে হবে বিবেক, বুদ্ধি, চেষ্টার অনেক কাঠ‑খর।
- কুরআনের পদ্য বা দ্বিতীয় স্তর – এই স্তরটি প্রথম স্তর থেকে অধিকতর গভীর। শুধু শব্দার্থ বা আভিধানিক জ্ঞানের গণ্ডিতেই এটি আবদ্ধ নয়। বরং এটি কুরআনের কাব্যিক স্তর। শব্দের সাথে ভাবের সংমিশ্রণ হয়, উপযুক্ত ভাব প্রকাশের সাথে ছন্দের যে সম্পর্ক তার সাথে পাঠকের প্রথম পরিচয় ঘটে এখানে। মহাস্রষ্টা ও শিল্পীর শৈল্পিক গুনাবলির সম্পর্কে চেতনার সৃষ্টি হয় এই স্তরে। এই পর্যায়ে কুরআনকে বোঝাটা আরও দুষ্কর হয়ে উঠতে পারে। সেটা বুঝতে গেলে আপনার নিজের নফসের লেভেল গুলো বুঝতে হবে। আপনার নফস যেই লেভেলের সেই লেভেলে আপনি অনুধাবন করতে পারবেন, উপলব্ধি করতে পারবেন।
- কুরআনের সুর‑লহরি বা তৃতীয় স্তরঃ মূলত এটি হচ্ছে কুরআনকে উপলব্ধি করার বা জানার গভীরতম স্তর। এই স্তরেই পাঠক কুরআনের অন্তর্নিহিত নূরের সন্ধান পায়। সেই নূর বুঝতে গেলে তাঁকে মুত্তাকী হতে হয়। তাহলেই কোরআনের যে নূর, যে মূল জ্যোতি যেটা আল্লাহ অবতীর্ণ করেছেন, নাযিল করেছেন তা তিনি উপলব্ধি করতে পারবেন। যত টপ ক্লাস বা উচ্চমানের মুত্তাকী আপনি হতে পারবেন তত টপ ক্লাস‑উচ্চমানের কোরআনের নূর আপনি অর্জন করতে পারবেন। আর কুরআনকে বোঝার দক্ষতা হবে আরও জ্ঞানগভীর এবং আরও প্রাচুর্যপূর্ণ। এই যে সুর লহরী বা সঙ্গীত এই ভাষাতেই আল্লাহ সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ কথাগুলো বলেছেন। এজন্য এই সুর লহরি বা নূরের মর্ম উপলব্ধি করতে গেলে আপনাকে সেই ভাষার সাথে রিদম বা ছন্দের তাল মেলাতে হবে । তখনই কুরআনকে আপনি বুঝতে সক্ষম হবেন পূর্ণাঙ্গরূপে।
আমরা জানি যে, দাউদ নবীর উপরে যে জাবুর নাযিল করা হয়েছিল সেটা কিন্তু এই সুর লহরির মাধ্যমেই তাকে তেলাওয়াত করতে হতো কিন্তু খুব দুঃখের বিষয় যে আমাদের প্রচলিত শরীয়ত এই সুর লহরিকে হারাম বলে ঘোষণা করেছে।
“আমি আমার পক্ষ থেকে দাঊদের প্রতি একটি অনুগ্রহ করেছিলাম। হে পর্বতমালা! তোমরা দাঊদের সঙ্গে আমার মহিমা গাও আর পাখীরাও! আমি লোহাকেও তার জন্য নরম করেছিলাম।“(৩৪ঃ১০)
কিন্তু তারচেয়ে বেশী আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে প্রচলিত মোল্লা সমাজ যারা সুর‑সঙ্গত-সঙ্গিতকে হারাম বলে ঘোষণা করল তারাই কিন্তু নিজেদের ওয়াজ মাহফিলে (যেখানে স্বাভাবিকভাবে কথা বলাই বেশি উপযুক্ত ছিল) সুর লহরি ছাড়া ওয়াজ করে না। নিদারুন গগন বিদারী চিৎকার দিয়ে তারাই গেয়ে ওঠে ‘’চিল্লায়ে বলেন সুবহান আল্লাহ্! ঠিক কি না!’’ তাদের সামনে থাকা রাশি রাশি উৎসুক জনতাও সাথে সাথে গেয়ে যায় সুবহান আল্লাহ্ নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবর ইত্যাদি ইত্যাদি। কি ভয়ঙ্কর স্ববিরোধিতা আপনি নিশ্চয়ই উপলব্ধি করতে পারছেন?!
আবারও কুরআনের নূর এর আলোচনায় ফিরি। কুরআনের সুর‑লহরী স্তরে পৌঁছতে পারা, কুরআনের মর্মকথা বুঝতে পারা যারা এই মুত্তাকী হতে পারবে, তারাই টপ লেভেলের উচ্চমানের মুসলিম হতে পারবে ( সূরা হুজরাতের ১৩ আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ‘’আল্লাহর নিকট সেই লোকই অধিক সম্মানীয় যে লোক অধিক মুত্তাক্বী’’) এই ধরনের মানুষদের দিয়ে যদি কোরআনের অনুবাদ করানো হতো তাহলে সেটাই হতো সবচেয়ে সুন্দর, পারফেক্ট, পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে এযাবৎকাল পর্যন্ত কোরআনের অনুবাদ যারাই করেছেন তারা বেশিরভাগই ছিলেন পেশাদার মানুষ এবং কোনো না কোনো রাজা, বাদশাহ বা সরকারের পৃষ্ঠপোষক, সমর্থক বা বেতনভুক্ত দরবারি আলেম। কুরআনের সঠিক ও পরিপূর্ণ অনুবাদ ও মর্মার্থ নিশ্চিত করার পরিবর্তে তাঁরা তাঁদের সমসাময়িক বাদশাহদের গুণকীর্তনই নিশ্চিত করেছেন। আর অল্পসংখ্যক মানুষ যারা পেশাদার বা দরবারি বা রাজা-বাদশাহদের আশীর্বাদপুষ্ট ছিলেন না, শুধু ফি সাবিলিল্লাহ বলে আল্লাহর ওয়াস্তে দুর্বলচিত্তে কুরআন চর্চা করেছেন তারা সেই মাপের মুত্তাকী হয়ে উঠতে পারেননি কুরআনের সেই তৃতীয় স্তরের গভীরতা অর্জন করতে না পারায়। যে কারণে সেভাবে সুন্দর সঠিক যথাযথ অনুবাদ বা তাফসির বা ভাবার্থ তারা করতেও পারেননি। আর ওরকম মুত্তাকি-মুমিন হতে না পারলে যথোপযুক্ত অনুবাদ করাটা তাদের পক্ষে যে অসম্ভব এবং অবাস্তব হয়ে দাঁড়াবে তা নিশ্চয়ই আমরা এতক্ষণে উপলব্ধি করতে পারছি।
এক্ষেত্রে আরেকটি অন্তরায় ছিল – এই অনুবাদকারীগণ সূরা আল ইমরানের সাত নাম্বার আয়াতে উল্লেখিত মুহকামাত আয়াত আর মুতাশাবিহা আয়াত, কুরআনের এই দুই ধরনের আয়াতের মাঝে বড় ধরনের গণ্ডগোল পাকিয়ে ফেলেছেন। কোরআনের অনেক অনেক আয়াত আছে যেগুলো মুহকাম ‑পরিষ্কার ও স্পষ্টভাবে আল্লাহর হুকুম‑আহকাম, নির্দেশ ও নিষেধ বর্ণনা করছে। কিন্তু কোরআনের বিশাল একটা অংশ জুড়েই আছে মুতাশাবিহা — ভাববাদ, সাদৃশ্যপূর্ণতা ও দর্শনের কথা। এগুলো অতি সাধারণ বা বেসিক লেভেলের পড়ালেখা করা মানুষের পক্ষে অনুবাদ করা সম্ভব নয় যতক্ষণ না পর্যন্ত তার মধ্যে সেই নূর আসবে, সেই নফসের মুতমাইন্না আসবে। এমনকি মুহকামাত আয়াত আর মুতাশাবিহা আয়াত এর পার্থক্য বোঝাই তাঁদের জন্য দায়। তাই একজন কুরআন অনুবাদক যতক্ষণ পর্যন্ত না নূর, নফস, রুহ অনুধাবন করতে পারবেন এবং মুত্তাকী হওয়ার চেষ্টা সাধনায় রত থাকবেন, তার জীবনের লক্ষ্য যতক্ষণ পর্যন্ত খাঁটি মুত্তাকী হওয়া নির্ধারণ করতে না পারবেন ততক্ষণ পর্যন্ত এই আয়াতগুলো তার পক্ষে অনুবাদ করা কখনোই সম্ভব হবে না। আর এটা করাটাও উচিৎ নয় কারো জন্য। কুরআনের অনুবাদকে একটি ছেলেখেলা হিসেবে নেয়াও উচিৎ নয়। অন্য কেউ না জানলেও একজন অনুবাদকারী নিজেতো অন্তত জানেন যে তাঁর জ্ঞানের পরিসীমা কতটুকু। তা জেনে বুঝেও প্রজন্মের পর প্রজন্মেকে দ্বিধা ও সংশয়ে ফেলার এই ইচ্ছাকৃত আয়োজন নিঃসন্দেহে একটি বড় পাপ! আর সেটাই ঘটেছে আমাদের তথাকথিত কুরআন অনুবাদকদের ক্ষেত্রেও। তাঁরা কখনো মুহকাম আয়াতকে মুতাশাবিহা ভেবে ভুল অর্থ করেছেন আবার কখনো মুতাশাবিহা আয়াতকে করেছেন লিটারাল বা আভিধানিক অর্থ। আবার কখনো বা ইচ্ছে করেই এমন কাজ করেছেন তাঁরা, নিজেদের স্বার্থ‑সিদ্ধির জন্য, নিজেদের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করার জন্য। আর মুহকাম‑মুতাশাবিহা আয়াত এর এই গণ্ডগোলের মাঝে পড়ে সাধারন মানুষ বিভ্রান্তির শিকার হচ্ছে কখনো আল্লাহ্র একদিন মানুষের পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান, সূর্য কর্দমাক্ত জলের মধ্যে ডুবে যায় আবার সূর্য উঠার সময় আল্লাহর আরশের নিচে সেজদায় লুটিয়ে পড়ে, পৃথিবীকে চ্যাপ্টা বিছানার মতো করে সৃষ্টি করা হয়েছে – ইত্যাদি ইত্যাদি অবৈজ্ঞানিক তথ্য কুরআনে আছে মনে করে। আসলে এই সমস্যার জন্য দায়ী মোল্লাদের তালগোল পাকিয়ে ফেলা অনুবাদ। কারন তাঁরা রূপক আয়াত আর সাধারন আয়াতের মধ্যে পার্থক্য করতে পারেন নি আবার কখনো ইচ্ছে করেই করেন নি। কুরআনের শব্দগুলো নিয়েই তাঁরা খেলেছেন এক বিকৃত খেলা। যে অল্প কিছুসংখ্যক মুসলিম কুরআন সত্যিই বুঝতে চান তাদেরকে চরম বিপদে ফেলে দিয়েছে এই অনুবাদ বিভ্রাট।
এর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে যাদেরকে আমরা আলেম হিসেবে গণ্য করি, হুজুর মনে করি, ভাবি যাদের নামের আগে মুফতি আছে, মাওলানা আছে, হাফেজ আছে, আল্লামা আছে, যার নামের আগে যত বেশি টাইটেল বা লকব থাকে তারাই বুঝি তত বড় আলেম ওলামা। কিন্তু আশ্চর্যর বিষয় হচ্ছে আল্লাহর চোখে এরা কোন আলেম‑ওলামাই নন। তাহলে আল্লাহ্র চোখে এই আলেম কারা? তা জানলে আমরা হয়তো আঁতকে উঠবো। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সুরা ফাতিরের ২৮ নাম্বার আয়াতে বলেছেন যে যারা আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি ভয় করে তারাই হচ্ছে আলেম উলামা বা জ্ঞানী।
দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় হচ্ছে এই ধরনের আলেম কিন্তু গত ১৪০০ বছরের ইতিহাসে খুব কমই এসেছেন। আল্লাহর দৃষ্টিতে বা ইসলামের দৃষ্টিতে বা কোরআনের দৃষ্টিতে যারা প্রকৃত আলেম, সেই আল্লাহভীরু, সেই মুত্তাকী, উপলব্ধির গভীরতম স্তরে পৌঁছতে পারা সেই প্রকৃত আলেমরা সংখ্যায় এতটাই কম এসেছেন যার ফলশ্রুতিতে কোরআনের প্রকৃত অনুবাদ বা ভাবার্থ সেভাবে করা হয়ে ওঠেনি কখনোই। সুতরাং যারা এই অনুবাদগুলো করেছেন তারা সেই নূরের আলোকে নিজেদের উদ্ভাসিত করতে পারেননি। শুধু গদ্য সাহিত্যের মত করেই ডিকশনারী থেকে শাব্দিক অর্থ নিয়েই তারা অনুবাদগুলো করেছেন। মহাগ্রন্থ আল‑কুরআনের যে কাব্য, দর্শন, ভাববাদ, এর যে সুর‑লহরী-নূর সেই পর্যায়ে তো তারা কখনো পৌঁছতেই পারেননি বা উপলব্ধি করতে চাননি।
ভাবার্থ, ভাববাদ বা দর্শন নিয়ে কথা বলতে গেলে এর কিছু বাস্তব উদাহরন টানা প্রয়োজন। যেমন ধরুন- “শৈবাল দিঘিরে বলে উচ্চ করি শির, লিখে রেখো এক ফোঁটা দিলেম শিশির।”
স্বাভাবিকভাবে শুধু শাব্দিক বা আভিধানিক পর্যায়ে এর অনুবাদ যদি কেউ করে, সেটা যে ভাষায়ই হোক — এটাকে যদি কেউ ইংরেজিতে বা আরবিতে বা উর্দুতে বা হিন্দিতে অনুবাদ করে, যারা এই অনুবাদটা পড়বে তারা কিন্তু এর মূল ভাব বা ভাবার্থ কখনোই উপলব্ধি করতে পারবে না। কবি আসলে এই পঙক্তি দুটিতে কে বোঝাতে চেয়েছেন? আর এর বিষয়বস্তুই বা কি? এর অন্তর্নিহিত শিক্ষাই বা কি? এটা কখনোই অন্য ভাষায় যখন এর শুধু শাব্দিক বা গদ্যরীতির অনুবাদ করা হবে সে ভাষার পাঠকেরা উপলব্ধি করতে পারবে না। এমনকি নিজ ভাষায় (বাংলা ভাষায়ও কেউ বুঝতে পারবে না) যতক্ষণ পর্যন্ত না পাঠক তার নিজের নফসটাকে (বিবেক‑বুদ্ধি-মন), তার জ্ঞানটাকে উপলব্ধির ওই লেভেলে নিয়ে যেতে পারবে। এই কবিতার ছন্দময় পঙক্তি দুটির মূল বক্তব্যটা আসলে কি? লেখক কি বোঝাতে চেয়েছিলেন? শুধুই শৈবাল‑দীঘির জীবন কাহিনী নাকি মানুষের স্বার্থপরতা, হীনতা আর শঠতার জ্বলজ্যান্ত বাস্তবতা?
আরেকটি উদাহরন হতে পারে রবি ঠাকুরের সেই বিখ্যাত দুটি লাইন –
“গগনে গরজে মেঘ ঘন বরষা, কুলে একা বসে আছি নাহি ভরসা।”
এই লাইন দুটির বিদেশী ভাষার অনুবাদ করাতো দূরের কথা, কোন বাঙালিও যদি এটা বুঝতে চায় যার ওভাবে দার্শনিকতা, সাহিত্যজ্ঞান ও প্রজ্ঞার মাত্রা সেই পর্যায়ে যায়নি, কিছুই বুঝতে পারবে না। উল্টো লেখককেই বোকা-নির্বোধ ভেবে বসবে। কারন সে শুধুই শাব্দিক আর আভিধানিক পর্যায়ে থেকেই এর অর্থ করার চেষ্টা করবেঃ গগনে অর্থ আকাশে, গরজে অর্থ- শব্দ করছে তার মানে আকাশে মেঘ শব্দ করছে। ঘন বরষা মানে- প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। কুলে একা বসে আছি নাহি ভরসা সে বলবে- আরে ব্যাটা তুমি কুলে একা বসে আছো কেন? আকাশে প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে, মেঘের প্রচন্ড শব্দ হচ্ছে- আর তুমি কুলে একা একা বসে আছো? বাড়ি যাচ্ছ না কেন? পাগল নাকি তুমি? আবার বলছো যে নাহি ভরসা? বৃষ্টির দিনে ছাতা নিয়ে বের হওনি এখন ভরসা থাকবে কিভাবে? বোকার হদ্দ !
আবার যদি সে পড়ে একই কবিতার এই লাইন দুটি –
“ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোট এ তরী
আমার সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।”
সে লেখককে বলবে তুমি এত বোকা কেন? ছোট্ট একটা তরী। আর সেটার মধ্যে তুমি ধান দিয়ে সব জায়গা ভরে ফেলেছো। এখন বলছো যে সব ভরে গেছে ধানে। হায় হায় এখন আমি কিভাবে বাড়ি ফিরে যাব? কিভাবে নদী পার হব? ঢং করার আর যায়গা পাওনা?
অথচ এই কবিতায় লেখক সুনিপুনভাবে মানুষের মৃত্যুর সময়ে যে দুনিয়ায় গড়া সব অর্থ সম্পদ ফেলে রেখে একাই চলে যেতে হয়, কিছুই সঙ্গে নিয়ে যাওয়া যায় না, সেই চরম বাস্তবতা ফুটিয়ে তুলেছেন। তাই যেকোন সাহিত্যকর্ম, যেকোন কাব্যকথা, সেটা যে ভাষায়ই হোক না কেন তার প্রকৃত অর্থ বুঝতে গেলে তা শুধু শব্দে শব্দে অনুবাদ করলে বা শুধু শব্দার্থ পড়লে সেটা থেকে একটি পূর্ণাঙ্গ অর্থ করা সম্ভব নয়। এতে একটি সর্বাঙ্গীক অর্থ বোঝাতো দূরের কথা, হয়তো মূল টেক্সটের ৫% ও অনুধাবন করা সম্ভব নয়। বরং এই পদ্ধতিতে অনুবাদকৃত লেখার অর্থ বিকৃত হওয়ার সম্ভাবনাই অত্যাধিক। এমনি অসংখ্য কবিতা, গান, কাহিনীর উদাহরণ দেয়া যায়। যেমন-
“মন মাঝি তোর বৈঠা নেরে আমি আর বাইতে পারলাম না।”
“লালন মরলো জল পিপাসায় থাকতে নদী মেঘনা।”
“হাতের কাছে ভরা কলস, তৃষ্ণা মেটে না।”
“বাড়ির পাশে আরশি নগর, সেথা এক পরশী বসত করে।”
“খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়?” তারে ধরতে পারলে মন বেরি দিতাম পাখির পায়।”
“যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে!”
” ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি”
“বাবুই পাখিরে ডাকি বলিছে চড়াই, কুঁড়ে ঘরে থাকি করো শিল্পের বড়াই।”
এমনি আরও কতো শত উদাহরন দেয়া যায় তার কোন হিসাব নেই। যে মানুষ এমনি কাব্যকথার গভীর দর্শনতত্ত্ব, সুনিপুন ভাবার্থ বোঝার চেষ্টা করে না বা বোঝার মতো জ্ঞান ও প্রজ্ঞা রাখে না, নিঃসন্দেহে সে কুরআনের নিগূঢ়ত্ব ও তাৎপর্যপূর্ণ আয়াতগুলোর পূর্ণাঙ্গ অর্থও বুঝতে পারবে না। কারন কুরআনতো জগতের অন্য যেকোন শিল্পীর শিল্পের চেয়ে অধিকতর সুন্দর, জ্ঞান‑প্রজ্ঞায় সুউচ্চ, দর্শনতত্ত্বে গভীরতর, আরও বেশি প্রাচুর্যপূর্ণ।
কোরআনে এমনি অনেক আয়াত আছে যেগুলো সুর‑লহরি, আবেগ ও ভাব দিয়ে যদি আপনি না পড়েন বা অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে সবটুকু উপলব্ধির অনুভুতি দিয়ে যদি না ধারণ করেন তাহলে কখনোই এর মূল মর্মার্থ অনুধাবন করতে পারবেন না। যেমন আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামীন। সাধারন অবস্থায় এই আয়াতটি পড়লে এর একটি অতি সরল অর্থ হয়তো আপনি উপলব্ধি করতে পারবেন কিন্তু তা হবে ভাসা ভাসা, অগভীর এবং ম্লান। কিন্তু ভাবুন তো, এই একই আয়াত যদি আপনি গভীর রাতে, জীবন ও জগতের সকল ব্যাস্ততা ভুলে একটি অন্ধকার ঘরে একা একা বসে মনের সব আবেগ আর সুর‑সঙ্গিত দিয়ে উচ্চারণ করেন, পড়েন তখন এর কি তীব্র প্রভাব আপনার দেহ‑মন ও সমস্ত সত্তার উপর পড়বে? কি এক ঐশ্বরিক নূর আপনার আত্মাকে, আপনার সত্তাকে আলোড়িত করবে, প্রকম্পিত করবে – সেই অনুভুতি ভাষায় প্রকাশ করার মতোও নয়! আর তখন কুরআনের সেই আয়াতগুলো আর আপনার কাছে আরবী ভাষায় বা ভিন্ন একটি ভাষায় মনে হবে না, মনে হবে আপনারই নিজের ভাষা, হৃদয়েরই কথা, একান্তই আপনার সেই সঙ্গীত। এমনি অজস্র আয়াতে পরিপূর্ণ মহাগ্রন্থ, মহাপবিত্র আল‑কুরআন। এমনি ধ্যানমগ্নতার সাথে, মনযোগের সাথে, খুব সুর করে ঐ আয়াতগুলো পড়লে দেখবেন আপনা থেকেই অশ্রুসিক্ত হবেন, শিহরিত হবেন, আপনার সম্পূর্ণ চেতনায় যোগ হবে একটি নতুন মাত্রা। আপনি আবার নতুন করে বুঝবেন সকল প্রশংসা কৃতজ্ঞতাতো একমাত্র আল্লাহরই প্রাপ্য।কত শত নিয়ামতে আপনাকে তিনি ডুবিয়ে রেখেছেন!
একটু মধ্যম মানের মুত্তাকী হলে সুরা আদিয়াতের ইন্নাল ইনসানা লি রাব্বিহি লাকানুদ- নিশ্চয়ই মানুষ তার রবের প্রতি বড়ই অকৃতজ্ঞ ‑পড়লেও দেখবেন যে আপনার খুব খারাপ লাগবে, কষ্টে বুক ফেটে যাবে, পানি চলে আসবে চোখেও! কতো শত সহস্র নিয়ামতে ডুবে থেকেও আল্লাহ্ কি কি দেননি তা নিয়েই আমরা সব সময় হতাশ, আল্লাহর প্রতি অকৃতজ্ঞতা, অভিযোগ আর না-শোকরিতেই যেন ব্যাস্ত — ভেবে আপনার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়বে। এরকম অজস্র আয়াত, কাব্য, ছন্দ ও সুর কোরআনে আল্লাহ দিয়েছেন যেগুলো আসলে সুর‑লহরি-ভাব এর উপলব্ধির চর্চা ছাড়া পড়লে তার শতভাগ মর্ম আপনার হৃদয়ে কখনোই প্রবেশ করবে না।
দূর্ভাগ্যজনক! আমরা কুরআনের সেই গভীরতর বাকি দুইটা স্তর উপেক্ষা করে শুধুমাত্র একটা স্তরেই হয়তো সারা জীবন পড়ে থাকি। গদ্য‑সাহিত্য আকারে শুধু শাব্দিক ভাবেই অর্থ করে যাই, পড়ে যাই। তার উপর সেই শাব্দিক অর্থগুলোও আবার ইরানীয়ানদের ফার্সি ভাষা থেকে কপি পেস্ট করা! যাতে প্রকট প্রভাব রয়েছে তাদের এক সময়কার রাজধর্ম জরুথ্রষ্টবাদের। ইহুদী, খ্রিষ্টান থেকে ইসলাম গ্রহন করা কাব‑আল-আহবার, মুনাব্বে, দরবারি আলেম আবু হুরায়রাদের মনগড়া বিকৃত হাদীস কিংবা সিরাত ও ইসরাইলিদের ইহুদী রেওয়াতের ও তাফসীরের।
কুরআন যে সুর‑লহরি-ভাব দিয়ে উপলব্ধি করতে হবে তারই আদেশ আল্লাহ্ দিয়েছেন সুরা মুজাম্মিলে – ধীরে, ধীরে স্পষ্ট করে তারতীল বা উপযুক্ত ছন্দে- ছন্দে পড়তে হবে কুরআন। অপরদিকে আমাদের তথাকথিত হুজুররা এই সুর মূর্ছনা হারাম ঘোষণা করেছেন। আবার তাদের নিজেদেরই ওয়াজ মাহফিলে, আজানে বা গজলে অথবা সদ্য নামকৃত ইসলামি সঙ্গীতেই গান, সুর- লহরী ছাড়া জমেনা। কখনো ওয়াজ মাহফিলের মাঠে আবার কখনো মিলাদ মজিলশে তাদের প্রয়োজন হয় শায়েরি হিন্দি, উর্দু, ফার্সি, গজল। এসব ছাড়া তারা ইসলামি দর্শন প্রকাশ করতে পারেনই না, এমনকি প্রয়জনে উর্দু, হিন্দি, বাংলা গানের সুর চুরি করে তারা ইসলামি জলসা ও আসর জমান। কাওয়ালী, ‘’দামা দাম মাসকালেন্দার’’, ‘’শাহ আলী’’, ‘’খাজা বাবাদের’’ শানে তারা তালে তালে মাজার আর দরগাহ মাতান। দুরুদ, কিয়াম, মিলাদ আর নাতে রাসুল নাম দিয়ে সুরের মূর্ছনায় তারা ভাসিয়ে দেন তাদের জলসা। এদের স্ববিরোধীতার উপাখ্যান যেন এক আবেগি তাওহিদি জনতার অশ্রুসিক্ত কান্নার জল।
একথা ভুলে গেলে চলবে না যে মহাজগতের মহাস্রষ্টার প্রেরিত প্রতিটি ঐশী গ্রন্থের মূল বৈশিষ্ট্যগুলোর একটি হচ্ছে- পৃথিবীর সবচেয়ে টপ ক্লাস, উঁচু মানের সাহিত্য থাকে এর মধ্যে। দর্শন, কাব্য, সৌন্দর্য, শিল্প, ফিলোসফি- ভাববাদে পরিপূর্ণ থাকে তাদের প্রতি আয়াত। প্রতিটি পাতায় থাকে ঐশী ছন্দ ব্যঞ্জনার মহাপ্রাচুর্য । যত ঐশী গ্রন্থ, যত আসমানী কিতাব আল্লাহ পাঠিয়েছেন কোরআন কিন্তু মোটেই তার ব্যতিক্রম নয়।
তবে সব কিছুকে ছাড়িয়ে আসমানী কিতাবের শ্রেষ্ঠত্ব যেখানে বিমূর্ত হয়ে ওঠে তা হচ্ছে এর সারবস্তু – এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে, এর নুরানি আলোকবর্তিকায়। একজন সাধারণ মানুষ কিভাবে অসাধারণ মানুষ হয়ে উঠবে, মহামানবে রুপান্তরিত হবে, পরিণত হবে তার শ্রেষ্ঠতম মানুষ সত্তায় — তার পূর্ণাঙ্গ ও মৌলিক নির্দেশনা থাকে ঐশী গ্রন্থে, আসমানি কিতাবে। একটা মানুষ কিভাবে তার চারপাশটাকে তার মহান আদর্শের গুণে আলোকিত করবে তা থাকে এর সকল আদেশ‑নিষেধ‑উৎসাহের তালিকায়।
হে মানুষ! ‘তোমরা তোমাদের সেই প্রতিপালকের ইবাদাত কর যিনি তোমাদেরকে ও তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পার’। (বাকারা, আয়াত ২১)
এমনিভাবে সুরা বাকারার ১৮৩ আয়াতে রোজা/সিয়ামও দিয়েছেন মুত্তাকী হওয়ার জন্যই। সুরা হুজুরাতের ১৩ আয়াতেও দেখা যায় আল্লাহর কাছে এই পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে সম্মানিত ও মর্যাদাবান হচ্ছে মুত্তাকীরা। সুরা মারইয়ামের ৭৪ আয়াতে দেখি হাশরের মাঠে বিশেষ অতিথি হিসেবে মুত্তাকীরাই উপস্থিত হবেন। কুরআনের পাতায় পাতায় শুধু মুত্তাকী হওয়ার ফিকির, নির্দেশনা আর ওয়াজ! কোরআনে বর্ণিত মুত্তাকীর গুণগুলো আয়ত্ত করতে পারলেই আপনি হবেন আল্লাহ্র চোখে সবচেয়ে সম্মানিত, সবচেয়ে প্রিয়। এই গুণগুলো নিজের মধ্যে ধারণ ও লালন করলে হাশরে নূর থাকবে আপনার পাশে।আর সেই গুণগুলো যখন একটা মানুষ আয়ত্ত করতে থাকে তখন তার আশেপাশে যা থাকে, যারা থাকে সবাই আলোকিত হয়। সেই ঐশী নূরের তাজাল্লিতে সবাই ঝলসে যায়। তার পরিবারের মানুষ, সমাজের মানুষ, এমনকি সমগ্র দেশের মানুষও সেই নূরের ঔজ্জ্বল্যে আলোকিত হয়ে যায়। আর এমন তাকওয়ার পর্যায়ে পৌঁছতে কুরআনকে গভীরভাবে, পূর্ণাঙ্গরূপে জানতে ও বুঝতে হবে। কুরআনের সুরময় ভাবার্থ, দর্শন ও জ্যোতির সন্ধান পেতে হবে। শুদু শব্দার্থের গণ্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে তা কি কখনো সম্ভব?
সমগ্র জগতের সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, রক্ষাকর্তা, পরিচালক, রবের পক্ষ থেকে যে ঐশী গ্রন্থ এসেছে তা পরিপূর্ণ থাকবে প্রজ্ঞায়, রহস্যে, সত্যে, সৌন্দর্যে, এটাই তো স্বাভাবিক তাই না? অতীত ‑বর্তমান ‑ভবিষ্যৎ, দৃশ্য ‑অদৃশ্য, গোপন- প্রকাশ্য, জীবন‑মৃত্যু-সৃষ্টির রহস্য, আধ্যাত্মিকতা, দর্শনতত্ব কিছুই বাদ যাবেনা তা থেকে। মহামনাবদের মহৎ আদর্শের বর্ণিল উপাখ্যান, সফলকামদের উত্তম আদর্শ, জান্নাতে যাওয়ার সুনিশ্চিত পথনির্দেশনা এবং সবশেষে নিরন্তর সাধনার পুরস্কার ও প্রশান্তি আর রাব্বুল আলামিনের খলিফায় পরিণত হয়ে কুন ফা ইয়াকুন এর মালিক হওয়ার প্রতিশ্রুতি – এই সবকিছুতো একজন গভীর মনযোগী মানুষ ছাড়া কেউই বুঝতে পারবে না। অন্যথায় একজন পাঠক শুধুই শব্দে শব্দে কুরআনকে পড়েই যাবে, এর নির্যাস পাবে না। কুরআনে তাইতো আল্লাহ্ বারবার প্রশ্ন করেছেন তারা কি এর আয়াতগুলো নিয়ে গভীর ধ্যান‑চিন্তা করে না?
তারা কি কুরআনের মর্ম বিষয়ে গভীর ভাবে চিন্তা করে না? (সূরা ৪, আয়াত ৮২)
একটা গ্রন্থের মধ্যে একসাথে কত ক্যাটাগরি, সেকশন, শাখা-প্রশাখা, বিষয়বস্তুর উপস্তিতি থাকতে পারে? আমরা গণিত বই পড়লে শুধু অংকের চিন্তা আসে, ইংরেজি বই পড়লে নির্দিষ্ট ভাষাটি সম্পর্কে জানার উন্নতি বৃদ্ধি ঘটে, হিসাববিজ্ঞান বই পড়লে হিসাব‑নিকাশ করতে শেখা যায় কিংবা ফিজিক্সের বই পড়লে বিজ্ঞানের চিন্তা প্রসারিত হয়। কিন্তু এই ঐশী আসমানী কিতাব এমনই এক গ্রন্থ যে এর মধ্যে সমস্ত কিছু ‑আধ্যাত্মিকতা-দর্শন‑ভাববাদ থেকে শুরু করে একেবারে প্রতিদিনকার আচার ব্যবহার,নারী পুরুষের প্রণয়, বিয়ে, বিচ্ছেদ, মানবাধিকার, দাম্পত্যকলহ, সম্পদ বন্টন, গরীব দুখি অসহায়ের হক, যুক্তিবাদ, বিজ্ঞান, পদার্থ, রসায়ন, শারীরবৃত্ত, মহাবিশ্বের সৃষ্টি রহস্য ( বিগ ব্যাং, এক্সপ্যান্ডিং ইউনিভার্স) সবকিছু এত চমৎকারভাবে কখনো থরে থরে সাজানো আবার কখনো হীরামুক্তার মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
শুধু এই ব্যপারটা উপলব্ধি করতেও একটা মানুষকে প্রচন্ড জ্ঞান সাধনা করতে হয়। কারণ এই মুক্তার মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আয়াতগুলো কোনটা কোন ক্যাটাগরির মধ্যে পড়ে এবং সেই আয়াতগুলো থেকে কি কি শিক্ষণীয় তা ক্যাটাগরাইজ করাটাও অতি সাধারন মানের নফসের অধিকারীর পক্ষে দুঃসাধ্য। এজন্যই আল্লাহ বারবার কোরআনে উপদেশ দিয়েছেন সবসময় পড়ো, পড়তে থাকো- কখনো রাতের গভীরে, কখনো সকালে, কখনো সন্ধ্যার কথা বলেছেন আবার কখনো বলেছেন সারাক্ষন তুমি কোরআন নিয়ে চিন্তাভাবনা করো, গবেষণা-ধ্যান করো।
একবার দুবার পড়লেই যদি হৃদয়ঙ্গম করা যেত বা শুধু শব্দার্থ পর্যায়ে থাকলেই যদি এর মূল ফিলোসফি, ভাববাদ, আধ্যাত্মিকতা-দার্শনিকতা উপলব্ধি ও আত্মস্থ করা যেতো তাহলে আল্লাহ এতবার পড়তে বলতে না। গভীরভাবে চিন্তা করতে বলতেন না।
কুরআনের এই নূরকে অন্তরে গেঁথে নিতে হলে আপনাকে সবসময় কুরআনের নুরের সাথে একটা প্রেমময় মধুর সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। একজন কুরআন প্রেমীর জন্য এমনি একটি ভাবনার খোরাক হতে পারে নিম্নোক্ত এই আয়াতটিঃ
“বলো, আমার প্রতিপালকের বাণী লেখার জন্য সমুদ্র যদি কালি হয় তবে সে লেখা শেষ হবার আগেই সমুদ্র নিঃশেষ হয়ে যাবে। তারপর যদি এর অনুরূপ আরো সমুদ্র আনা হয় তাও শেষ হয়ে যাবে।‘’ (তবু আল্লাহর বাণী শেষ হবে না) (সূরা কাহাফ, আয়াত ১০৯)
এরকম আরেকটি আয়াতঃ
“যদি পৃথিবীর সব গাছ কলম হয় ও সমুদ্র তার কালি হয় এবং সমুদ্রের সাথে আরো সাত সমুদ্র যুক্ত হয় (এবং তা দিয়ে আল্লাহর কথা লেখা হয়) তবুও আল্লাহর কথা ফুরাবে না।‘’ (সুরা লুকমান আয়াত ২৭)
এমন কথা শোনার পর কোন হৃদয় আবেগাপ্লুত হবে না? বিনয়ে আকুল হবে না? ধ্যানে নিমগ্ন হবে না? আল্লাহ্র প্রেমে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠবে না? কেমন সে প্রভু যার কথা সমস্ত সমুদ্রের জলেও লেখা শেষ হয় না? তবে তো এই ঐশী কুরআনের প্রতিটি কথারই গভীরতা এক একটি পূর্ণ জোয়ারে বহমান নদী-সাগরের চেয়েও অনেক বেশি। এর এক একটি আয়াত তো বছরের পর বছর অধ্যয়ন করলেও তার মর্মার্থ, নিগুরত্ব, সৌন্দর্য, অনুরাগ শেষ হবে না। জীবনের কাল ফুরিয়ে গেলেও কুরআনের নূর তো ফুরাবে না। দুঃখজনক সত্য এটাই যে প্রায় ১৪০০ বছর ধরে তথাকথিত নামধারী আলেমগন, জ্ঞানী ও বিদ্বানগণ সত্য‑যুক্তি-প্রমান‑বাস্তবতা বিবর্জিত মূর্খতা ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন নানা ধরনের কল্পকাহিনীর মানব রচিত বই দিয়ে কুরআনকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ এর ব্যর্থ প্রচেষ্টা করেই চলেছেন। কখনো উপনিষদ, কখনো তালমুদ, কখনো বিকৃত বাইবেল এর ওল্ড কিংবা নিউ টেস্টামেন্ট আবার কখনো হাদিসের ছদ্মবেশে তাঁরা চিরকালই কুরআনের সত্য থেকে মানুষকে শুধুই দূরে সরিয়ে নিয়েছেন। বুখারী, তিরমিজি, সুনান আবু দাউদ, ইবন মাজা – এরপর আবার আছে ফিকহ‑মাসালা-ইজমা-কিয়াস‑ফতোয়া আরও কতো কি! উদ্দেশ্য একটাই! এই সমস্ত মিথ্যের পাহাড় যেন কুরআনের স্বর্গীয় নূরকে কোন ভাবে ধামাচাপা দিতে সক্ষম হয়। যেন কুরআনের শানকে সংকুচিত করা যায়। যেন বলা যায় “কুরআন তো খুবই সংক্ষিপ্ত। এতে তো শুধু সারকথাটুকু আছে। বিস্তারিত জানতে চান? হাদিসে আসুন! নবীর সুন্নাহ অনুসরণ করুন। ইজমা-কিয়াস‑মাসালা-ফতোয়ার আলোয় জীবন গড়ুন। তাহলেই হবেন সফলকাম। পাবেন বেহেস্তের চাবি!”
শুধু এখানেই শেষ নয়! এই মোল্লাগণ কুরআনকে অসম্পূর্ণ বলেই ক্ষান্ত হননি। মানুষকে ছলে-বলে-কৌশলে বিশ্বাস করিয়ে ছেড়েছেন যে হাদিস, ফিকাহ, মাসালা, পীর, শায়েখের আশীর্বাদ ছাড়া কুরআন কখনই বোঝা সম্ভব তো নয়ই, উল্টো কুরআনকে মৌলিক ভাবে অধ্যয়ন করলে আপনি অবশ্যই নাস্তিক কিংবা কাফির, মুরতাদ হয়ে যাবেন। আর তাই কাফের, মুরতাদ কিংবা নাস্তিক হবার ভয়ে কেউ আর কুরআন নিয়ে গবেষণা-ধ্যান করার দুঃসাহস স্বপ্নেও করে না। ভয়ের এই বীজ ভালভাবেই মানুষের মনে বপন করেছেন মুফতি মৌল্ভিরা। বেশি কুরআন পড়লেই পথভ্রষ্ট হয়ে যাবে এই ধারণা এখন প্রতিটি মানুষের মনে ও মুখে। সবাই তাই “থাক বাবা অতো কুরআন পড়ে কাজ নেই” বলেই পালিয়ে বেড়ায় আল্লাহ্র কুরআন থেকে। আজ কুরআন এর স্থান হয়েছে ঘরের সবচেয়ে উঁচু কোন আলমারির উপরে, কাপড়ে জড়ানো মৃত লাশের মতো। তাঁকে অজু ছাড়া ছোঁয়া যায়না। যখন তখন পড়া যায়না। প্রতি অক্ষরে দশটি মাত্র নেকীর বাইরে তার আর কোন ফজিলত নেই। রাজত্ব এখন হাদিস‑ফিকাহ‑ফতোয়ার। জীবন পরিচালনার জন্য তারাই এখন আমাদের আসল সঙ্গী, প্রতিদিনের পরম বন্ধু। তাই এই হাদিসকে অস্বীকার করে শুধু কুরআনের আলোয় আলোকিত হওয়ার ইচ্ছা যে দুঃসাহসীই করবে, তার জন্য অপেক্ষা করছে বাহাত্তর হুরের সার্টিফিকেট প্রাপ্ত মুমিনদের হাতে নিদারুন মৃত্যু। মহাগ্রন্থ আসমানি কুরআনের বিরুদ্ধে গিয়ে যারা মিথ্যার সাম্রাজ্য গড়ে তুলল, তারাই এখন মুমিন। তাদের হাতেই এখন কিনা ইসলামের দখল। তারাই আজ ধর্মের বিধান দাতা। এই যখন অবস্থা তখন কিভাবে এমনটি আশা করা যায় যে মানুষ কুরআনকে কুরআনের উপযুক্ত মর্যাদার সাথে অধ্যয়ন করবে? গবেষণা করবে এর সুগভীর ভাবার্থ বোঝার জন্য? আত্মায় ও সত্তায় কুরআনের নূর ধারণ করবে?
এ পর্যায়ে কুরআনের ভাবার্থ না বোঝা এবং এর নানাবিধ কারন আলোচনার পর ঠিক এর পরবর্তী যে অন্তরায় মানুষের কুরআন বোঝার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করে থাকে সেটার (হাদিস এর প্রভাব) বিশদ আলোচনা করা হয়েছে।
চতুর্থ কারনঃ- (হাদিস‑ফিকাহ‑কল্পকাহিনী-কুসংস্কার‑পথভ্রষ্টতার দিকনির্দেশক ও রসদ; আজগুবি শরীফের তীব্র প্রভাব ও দাপট)
মনে পড়ে ইবলিশের সেই চ্যালেঞ্জ? আল্লাহ্র বান্দাদেরকে আল্লাহ্র হেদায়াত থেকে দূরে সরিয়ে নেয়ার সেই প্রতিজ্ঞা?
সে বলল- আপনার ক্ষমতার কসম! আমি ওদের সব্বাইকে অবশ্যই পথভ্রষ্ট করব। (সূরা সাদ, আয়াত ৮২)
ইবলিশতো মানবজাতিকে ধংসের পথে নিয়ে যেতে চায়। সমগ্র মানবজাতিকে পথভ্রষ্ট করাটাই তার স্বপ্ন সাধনা, তার মিশন।
আসলে মানবজাতির জন্য হেদায়াত কি? আর কিভাবে পথভ্রষ্ট করা যায় মানুষকে? উত্তর হচ্ছে – মানুষের পথপ্রদর্শনের জন্য স্রষ্টা যে আসমানি কিতাব প্রেরন করেন তা ভুলিয়ে দেয়া, যেকোন মুল্যে তা থেকে দূরে সরিয়ে নেয়া। এটাই হল সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি মানবজাতিকে ধংসের জন্য। আর তাই যুগে যুগে শয়তান ও তার অনুসারীরা যখনই যে ঐশী বাণী নাযিল হয়েছে তখনই তা থেকে মানুষকে সরিয়ে নিয়ে গেছে দূরে, বহু দূরে। কুরআনের পূর্বেও এমনটি ঘটেছে যখন ইঞ্জিল, তাওরাত এবং অন্যান্য আসমানি কিতাব এসেছিল। আজ কুরআনের ক্ষেত্রেও সেই একই ঘটনা ঘটে চলেছে। তথাকথিত আলেম ও বিদ্বানরা চিরকালই ঐশী গ্রন্থের কাছে যাওয়ার ক্ষেত্রে শুধু নিশেধাজ্ঞাই জারি করে গেছেন। আজ কুরআন মোল্লা মৌলভি ছাড়া একক ভাবে পড়া নিষিদ্ধ। আবার মধ্যযুগেও চার্চের ফাদার‑পাদ্রিদের অনুমতি ছাড়া বাইবেল পড়া কিংবা অধ্যয়ন করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল। সাধারন কোন মানুষের ঘরে চার্চের অনুমোদন ছাড়া বাইবেল পাওয়া গেলে তাকে পুড়িয়ে হত্যা করার রীতি ছিল! এই রীতিকে বলা যেতে পারে তৎকালীন খ্রিস্টধর্মের যাজকদের সহিহ হাদিসের রীতি। সনাতন ধর্মালম্বীদের কথাই ধরা যাক। একটা সময় ছিল যখন বেদ পড়াতো দুরের কথা, সাধারন মানুষের জন্য সেটা স্পর্শ করাও নিষিদ্ধ ছিল। যদি প্রমাণিত হতো যে অমুক নমশূদ্র পবিত্র বেদের বাণী শুনে ফেলেছে, সাথে সাথে সেই পুরোহিত ও ঠাকুর‑ব্রাহ্মণ নামধারীরা যারা নিজেদেরকে দাবী করতো তারা নায়েবে অবতার, পিতল গলিয়ে সেই নমশূদ্রের কানে ঢেলে দিয়ে তাদের সেই উপনিষদ (মানে তাদের সহিহ হাদিসের) রীতি-আদেশ পালন করতো। তারা তাই তাদের সেই সহিহ হাদিস, মানে আমাদের ভাষায় বলছি সহিহ হাদিস যেটা তখন তাদের ভাষায় ছিল উপনিষদ, সেই মানবরচিত উপনিষদের আইন অনুযায়ী এই কঠিন শাস্তি দিয়ে তারা মনে করতো তারা বিশাল পুন্য অর্জন করেছে! (যেমনটি আজ তথাকথিত মুমিনরা মনে করেন – কুরআনের অনুসারীদের হত্যা করে তাঁরা ভাবেন যে বাহাত্তর হুরের জান্নাতী টিকিট তাঁরা নিশ্চিত করেছেন)
কালের স্রোতে ভেসে ভেসে এসে সেই একই রোগ আজ মুসলিমদেরও ধরেছে। হয়তো একটু অন্যভাবে। তবে রোগটা একই। কুরআন স্রষ্টার বাণী। কিন্তু কুরআন ধরার দরকার নেই, পড়ার দরকার নেই। পড়লেও বোঝার কোন দরকার নেই। বুঝলেও বেশি বোঝার দরকার নেই। অধ্যয়ন করার আরও দরকার নেই। আর কুরআন গবেষণা? সেটার তো কোন প্রশ্নই আসে না! হুজুরদের ছাড়া কুরআন পড়া? সেটাতো একেবারেই নিষেধ। কুরআন বেশি পড়ার জিনিস নয়, পড়লেই নাস্তিক কিংবা কাফের হয়ে যাবে কিন্তু! আর তাই হুজুররা গড়ে তুলেছেন কুরআনের পাখিদের তৈরি করার এক অভিনব মেশিন। এই মেশিনে আটকা পড়ে কুরআনের তোতাপাখিরা শুধুই আরবী শব্দগুলো আউরে যায়, মুখস্ত করে। কিছু বোঝেনা। তারা শুধুই হুজুরদের প্রোগ্রাম করা রোবট মাত্র। তাদের বিবেক‑বুদ্ধি-চেতনা সবই হারিয়ে গেছে অনেক আগে। তাইতো শয়তান এখন নিশ্চিতমনে বিশ্রামরত। তাকে আর এই ভয়ে দিন কাটাতে হয়না কখন আবার এই জাতি কুরআনের নূরে আলোকিত হয়ে স্রষ্টার প্রিয়জনদের তালিকায় ভীরে যায়। আর মানুষরূপী শয়তান তথা মোল্লারা তো আছেই শয়তানের স্বপ্ন বাস্তবায়নে নিরন্তর প্রচেষ্টায় নিবেদিত। হাদিসের ঝুলি নিয়ে, কুসংস্কারের অন্ধকার ছড়িয়ে দিতে দৃঢ় তৎপর!
হাদিসের এই ব্রেইনওইয়াশ ও প্রোগ্রামিং এর অনন্তকালের ট্রেনিং শেষ করার পর একজন মানুষ চাইলেও আর কুরআনকে কুরআনের মতো করে দেখতে পারে না, পড়তেও পারে না, বোঝা তো দুরের কথা। আর এই অবস্থায় কুরআনের ভাবার্থ, দর্শন গভীর আধ্যাত্মিকতায় পৌঁছানো? নিঃসন্দেহে অসম্ভব!
সহিহ হাদিস নামের সেই শত সহস্র আজগুবি শরিফের সমুদ্র‑মহাসমুদ্র পেরিয়ে অবশেষে যখন কেউ কুরআনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছায়, ততক্ষনে অনেক দেরি হয়ে গেছে! চাইলেও সে আর হাদিসের মায়াজাল থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনা সহসা। কুরআনকেও সে হাদিসের ফিল্টার দিয়েই দেখে। ফলাফল – পড়া হলেও কুরআন আর বোঝা হয় না। অন্তত গভীরভাবে বোঝাটা আর সম্ভব হয় না। হাদিস ও হাদিসের হাদিস(ফিকাহ, মাসালা, ইজমা, কিয়াস ইত্যাদি) দ্বারা শিশুকাল থেকেই প্রভাবিত হওয়ার পর এবং এভাবে জীবনের অধিকাংশ বছর কেটে যাওয়ার পর একসময় মানুষের স্বাধীন চেতনা ও চিন্তাশক্তি হারিয়ে যায়। তার উপর আবার আছে তাফসির নামের আরেক কঠিন অভিশাপ। শান্তিতে কুরআন অধ্যয়নও সম্ভব নয় এই অভিশাপের কারনে। আপনি হাদিস রেখে কুরআন পড়তে এসেছেন বলেই ভাববেন না হাদিস থেকে মুক্তি পেয়েছেন! কুরআনের যে বইটা হাতে নিয়েছেন তার প্রতি পাতায় পাতায় ফুটনোট, ব্র্যাকেট, স্টার, কোটেশন ইত্যাদি দিয়ে আবারও আপনাকে গেলানো হবে তাফসীর নামের হাদিসের এক প্রিমিয়াম ভার্সন। পার্থক্য শুধু এই যে, এই বিশেষ ধরনের হাদিস আপনি কুরআনের বইয়ের মধ্যই একেবারে হাতের কাছেই পেয়ে যাবেন, বুখারি শরিফ না খুলেই! কি ভেবেছিলেন? এতদিনে কুরআনে এসেছেন, এবার আল্লাহ্র সাথে একটা সংযোগ গড়ে তুলতে পারবেন হাদিসের প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই? মোটেই না। তাফসির‑হাদিস আছে না আপনাকে বিভ্রান্ত করার জন্য? এবার আপনি কুরআনের কথা নয় এমন জিনিসকেও খোদ কুরআন ভাবতে বাধ্য হবেন। কুরআনের বইয়ে লেখা যে!
কুরআনকে বুঝতে শুধু বাধা দেয়াই নয়, হাদিসের আরেকটি ভয়ংকর মিশন হল মানুষকে কুরআন‑বিরোধী করে গড়ে তোলা। শত শত হাদিস আছে যেগুলো সরাসরি কুরআন বিরুদ্ধ অথচ সেটা বোঝাও সম্ভব নয় এমনকি এ নিয়ে কোন প্রশ্নও জাগে না মনে। আর এমন প্রশ্ন যাতে না জাগে তা আগে থেকেই নিশ্চিত করতে হাদিসকে দেয়া হয়েছে ‘ওহী গায়রে মাতলুহ’ এর খেতাব। মানুষ ভাবে কুরআনের মতো এটাওতো ওহী, একে অস্বীকার করি কি করে? আর তাই যতো কুরআন বিরোধীই হোক না কেন, একটি হাদিসের সত্যতা, মান, যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন কিংবা সন্দেহ কেউ করে না। তাছাড়া মোল্লা হুজুররা হাদিস মানাকে ফরজ বলে ঘোষণা দিয়েছেন। একে অস্বীকার করার অর্থ ইসলামকে অস্বীকার করা, কাফির হওয়া। তাই হাদিস ত্যাগ করে কেউ কুরআনকে বিধাতার একমাত্র বিধান হিসেবে নিলে তাকে হত্যা কিংবা সমাজচ্যুত করা, জেলবন্দী করা মহাপুন্যের কাজ এবং সহিহ আইনের বাস্তবায়নই বটে। হাদিসের এই চর্চা ও হাদিসপ্রীতি কুরআন থেকে মানুষকে শুধু সরিয়েই নেয়নি, করেছে কুরআন বিরোধীও।
একটি ধর্মের বিদ্বান আলেমরা সাধারনত হয়ে থাকেন মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসের অধিকারী। কিন্তু কালে কালে সেই আস্থা ও বিশ্বাসকে পুঁজি করে ধর্মের ধারক‑বাহকরা কখনো মোল্লা, কখনো ফাদার, কখনো যাজক আবার কখনো পুরহিতের বেশে এসে মানুষকে ঠকিয়েছেন পার্থিব স্বার্থ উদ্ধারের জন্য। কবরের আজাব নামের গাঁজাখুরি গল্প তৈরি করেছেন মিলাদ‑মাহফিল চল্লিশার ব্যাবসা চালু রাখার জন্য। এ যে বিনা ইনভেস্টমেন্টে কোটি টাকার বিজনেস ডিল! মানুষের ধর্মের অনুভুতিকে ব্যাবহার করে গেছেন শত শতাব্দী ধরে। হাদিসকে অবশ্য পালনীয় ও মাননীয় ওহী বানিয়ে তারপর সেই ওহী দিয়ে কবরের আজাবের মতো সম্পূর্ণ কুরআন বিরোধী একটি আইডিয়াকে সত্যতা দিয়েছেন এঁরা। অপরদিকে কুরআন বলছে পুনরুত্থানের দিন আল্লাহ্ যখন মানুষকে জাগ্রত করবেন তখন সে বলবে-
তারা বলবে, ‘হায় আমাদের দুর্ভোগ! আমাদেরকে আমাদের ঘুমের জায়গা থেকে কে উঠালো? (তাদেরকে জবাব দেয়া হবে) ‘‘এটা হল তাই- দয়াময় আল্লাহ যার ওয়াদা দিয়েছিলেন, আর রসূলগণও সত্য কথাই বলেছিলেন। (সূরা ইয়াসিন, আয়াত ৫২)
‘’ঘুম থেকে কে জাগাল?’’ তার মানে ঘুমিয়ে থাকবে মানুষ! মৃত্যুর পর থেকে পুনরুত্থান পর্যন্ত। কোন কবরের আজাব/শান্তি কিছুই থাকবে না। নইলে মানুষতো বলত ‘’আমাদের আজাব এর কবর থেকে কোথায় আনা হল?’’ অথবা ‘’আমাদের কবরের জান্নাত থেকে এ কোথায় এসে পড়লাম!’’ কুরআন বলছে হাশরের মাঠে সবার বিচার আচার হবে, সবাইকে আমলনামা তার হাতে দেয়া হবে। যার যার আমলের কিতাব তার তার হাতে দেয়া হবে, সে নিজেই নিজেরটা পড়তে পারবে, বলা হবে যে তুমি নিজে পড়ো। তখন কেউ কেউ ওই আমলনামা পড়ে খুব আনন্দিত হবে আবার অনেকে নিজের কপালে আঘাত করবে আবার কেউ কেউ নিজের হাত নিজেই কামড়াবে! হাদিসের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে হাশর এর আগেও মরার পরেই কবরের মধ্যে মাটি আপনাকে চাপ দেবে, ফেরেশতারা এসে মারধর করবে, সাপে এসে ঠোকরাবে ইত্যাদি ইত্যাদি — মানে দুই, চার, পাঁচ হাজার বছর ধরে আপনি এভাবে শাস্তি পেতেই থাকবেন বিনা বিচারে। যেখানে কবরের জীবন বলতে কোন জীবনই নেই, মৃত্যুর পর শুধু একটি ঘুমের জীবন হবে, সেখানে কিনা কবরের আজাব আছে বলে বলে মানুষকে ভয় দেখিয়ে বেড়ানোর এই খেলা। উদ্দেশ্য? ‘’আপনার প্রিয়জনের কবরের আজাব মাফ করিয়ে দিচ্ছি, এত টাকা দিন। আপনার পিতা-মাতা যতো বড় মানের পাপী ছিলেন সন্তান হিসেবে আপনার ততো বেশি খরচ করতে হবে কবরে পিতা-মাতাকে সুখে রাখার জন্য। কিভাবে সেটা করব? তা নিয়ে আপনার ভাবতে হবে না। আপনি টাকার বান্ডিলটা আমাদেরকে পাঠাবেন আর বাকিটা আমরা দেখব। এসব কাজের জন্যই তো আমরা হুজুর‑মোল্লারাই আছি, তাই না? আপনারা সাধারন মানুষরা নিশ্চিন্তে বাড়ি গিয়ে ঘুমাবেন আর আমাদের ফী দেবেন। ব্যস! বাকিটা আল্লাহ্র সাথে আমরা বুঝব। কবর আজাব মাফ করিয়ে নেয়া, বিপদ কাটিয়ে নেয়া, হাশরের দিন সুপারিশ এর ব্যাবস্থা করা, জান্নাত নিশ্চিন্ত করিয়ে নেয়া, বাহাত্তর হুরের টিকেট যোগার করা, এসব তো আমাদের মতো অলি-আল্লাহ‑পীর‑হুজুরদের কাজ।‘’
কুরআনের ব্যাখ্যার নামে হাদিস দিয়ে কুরআনের অপব্যাখ্যার এমনি আরও অনেক অনেক অনেক উদাহরন আছে। ধর্ম ব্যাবসায়ীরা তাঁদের ধর্ম ব্যাবসা চালু রাখার জন্য হেন মিথ্যা নেই যা বলেন নি। এমনি একটি বহুল প্রচলিত হাদিস থেকে পাওয়া বিশ্বাস হচ্ছে – হাশরের দিন পীর, গুরু, হুজুররা মানুষের জন্য সুপারিশ করে জান্নাত পাইয়ে দেবেন! অথচ আল্লাহ্ তাঁর পবিত্র গ্রন্থে বললেন –
তোমরা সেদিনকে ভয় কর যেদিন কেউ কারো উপকারে আসবে না এবং কারও সুপারিশ গৃহীত হবে না এবং কারও নিকট থেকে ক্ষতিপূরণ গ্রহণ করা হবে না আর তারা কোন রকম সাহায্যও পাবে না। (সূরা বাকারা – ৪২)
হাদিসের কদর মানুষের কাছে কোন পর্যায়ে নিয়ে গেছেন তথাকথিত মোল্লারা যে এমন একটি সম্পূর্ণ কুরআনের সাথে সাংঘর্ষিক কথা তাঁরা মানুষকে বিশ্বাস করিয়ে ছেড়েছেন। মানুষ আজ যার যার নিজের কর্মকে ঠিক‑ঠাক করার পরিবর্তে পীর‑মোল্লা ধরে। কারন তাঁরাই তো সুপারিশ করবেন আর জান্নাত পাইয়ে দেবেন এমন ওয়াদা করেছেন। আর তাঁদের ওয়াদার ব্যাক‑আপ হচ্ছে হাদিস! এসব ভ্রান্ত ধারনাইতো মানুষকে সচেতন হওয়া থেকে বাধা দিচ্ছে। হাশরের দিন সব ক্ষমতা থাকবে আল্লাহ্রই হাতে এবং কারো কোন অনুরোধে কোন কাজই হবে না, সময় থাকতেই তাই নিজেকে পরিশুদ্ধ করতে হবে এবং যারটা তাকেই করতে হবে- এই সহজ সত্য থেকে ভুলিয়ে রাখা হয়েছে মানুষকে হাদিস নামের ভাইরাস দিয়ে।
কুরআনের নূর যেন মানুষের কাছে না পৌঁছতে পারে এজন্য আরেকটি মিশন হচ্ছে কথায় কথায় ঘরে ঘরে হাফেজ বানানোর ওয়াজ । একজন হাফেজ ৭০ জনকে তাঁর সাথে জান্নাতে নিয়ে যাবেন। কাজেই হাফেজ হতে হবে। ছেলে মেয়েকেও হাফেজ বানাতে হবে। আত্মীয় স্বজনকে হাফেজ হতে উৎসাহিত করতে হবে। কুরআন বুঝে পড়লে তো আর কোন উপকার নেই, তাহলে বুঝে পড়ব কেন? কুরআন বোঝার ইচ্ছা যেন কারো মধ্য না জাগে তাই ঘরে ঘরে কুরআনের তোতাপাখি বানানোর এই মিশন। অথচ কুরআন নিজে তো কুরআন না বুঝে মুখস্ত করার কথা বলেনি! বরং বলেছে গভীর ভাবে কুরআন নিয়ে ভাবতে, পড়তে, বুঝতে, ধ্যান করতে। কুরআনের ব্যাখ্যার নামে এই সবই শুধুই কুরআন বিরোধী অ্যাজেন্ডা।
এভাবে একের পর এক মিথ্যা, অপব্যাখ্যা দিয়ে কুরআনের মর্মার্থ সাধারন মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। যেখানে আল্লাহ্ কুরআনে নিজেকে মুফতী ও হিদায়াতের একমাত্র মালিক বলেছেন, সেখানে এখন মাজার ও ধর্ম ব্যাবসায়ীরাই হয়ে উঠেছেন মুফতি-মাওলানা-পথের দিশারী! এ কি শিরক নয়? সেই পাপ নয় যার কোন ক্ষমা আল্লাহ্র কাছে নেই? এই মানুষেরা তো আল্লাহ্র স্থান নিয়ে নিয়েছে ফিরাউন, নমরুদদের মতো। কুরআনে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন বলেছেন-
তোমরা মান্য কর তাদেরকে- যারা তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান চায় না। উপরন্তু তারা সঠিক পথে পরিচালিত। (সূরা ইয়াসিন, আয়াত ২১)
এই একটি আয়াতেই আসলে হাদিস দ্বারা সৃষ্ট সকল ধর্মব্যাবসা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অবশ্যই আমাদের প্রানপ্রিয় মুফতি, মাওলানা, ধর্মযাজকরা এই আয়াত কখনোই সাধারন মানুষের কাছে পৌঁছতে চান না। তাহলে যে তাদের বিলাসীতার সাম্রাজ্য ভেঙ্গে পড়ে! যত মাজার‑মিলাদ‑ওয়াজ ব্যাবসা আছে তার কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না আর! এমনি অসংখ্য আয়াত আছে কুরআনে যা আলেমরা প্রায় সব সময় গোপন করে থাকেন। ফলে সাধারন মানুষ এই আয়াতগুলো বোঝা তো দুরের কথা, পড়ারও সুযোগ পায় না।
হাদিস দিয়ে আরেকটি কূটকৌশল হুজুররা করে থাকেন। সেটা হল মানুষকে দলে দলে বিভক্ত করা। গভীরভাবে লক্ষ্য না করলে হয়তো আমরা বুঝতে পারব না তথাকথিত মুসলিম সমাজে এত এত বিভক্তি কেন। আমাদের কাছে মনে হতে পারে এটি শুধুই একটি কাকতালীয় ঘটনা। কিন্তু এটাকি আসলেই কাকতালীয় বিষয় নাকি মোল্লাদের একটি কৌশল ও ষড়যন্ত্রের ফল? যাতে মুসলিমদের মধ্যে ঐক্য না আসে? কুরআনের আলোয় আলোকিত হয়ে মুসলিমরা যদি সত্যি সত্যিই এক্যবদ্ধ হয়ে যায় তাহলে তো মোল্লাদের ধর্ম‑ব্যাবসা বন্ধ হয়ে যাবে চিরতরে।
যারা নিজেদের দ্বীনকে খন্ডে খন্ডে বিভক্ত করে নিয়েছে আর দলে দলে ভাগ হয়ে গেছে তাদের কোন কাজের সাথে তোমার কোন সম্পর্ক নেই। তাদের ব্যাপারটি পুরোপুরি আল্লাহর ইখতিয়ারভুক্ত। তিনি তাদেরকে জানিয়ে দেবেন তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে। (৬‑১৫৯)
এসব হুজুরদেরকে কুরআনের আয়াত থেকে উদাহরন দিলেও তাঁরা হয় এরিয়ে যান, নয়তো বিকৃত ব্যাখ্যা করেন নয়তো সরাসরি অস্বীকার করেন। এদের মতো মানুষদের জন্যই আল্লাহ্ বলেছেন সূরা কাহাফের ৫৭ নম্বর আয়াতে কোন ব্যক্তিকে আল্লাহর বাণী স্মরণ করিয়ে দেয়ার পরেও সে যদি তা অস্বীকার করে এবং তার কৃতকর্ম ভুলে যায় তবে তার অপেক্ষা অধিক জালিম আর কে? তাই এই আলিম নামের জালিমরা তাদের মিশনের মাধ্যমে মানুষ যাতে কুরআন পড়লেও না বুঝতে পারে তার জন্য যাবতীয় পদক্ষেপ নিয়েই রেখেছেন।
পঞ্চম কারনঃ মানুষের স্বভাবজাত আলস্য
পঞ্চম এবং সর্বশেষ কারন হচ্ছে মানুষের স্বভাবজাত আলস্য। উপরোক্ত চারটি কারন যদি কোনভাবে কালে ভদ্রে সমাধান হয়েও যায়, তবুও কুরআন বোঝার জন্য সর্বশেষ অন্তরায় হয়ে এই আলস্য থেকেই যাবে মানুষের মধ্যে। সময়, শক্তি, জীবন ব্যয় করে সত্যের অনুসন্ধান করা, তার উপর আবার এত এত বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করেও সত্যের অভিযান চালিয়ে যাওয়া, এমন কঠিন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ মানুষের দেখা পাওয়া মুশকিল। হাজার বছরের লাহুয়াল হাদিসের ভীর ঠেলে, মোল্লা-যাজকদের রাঙ্গা চোখ উপেক্ষা করে, সমাজ‑পরিবারের কাছে মন্দ প্রমানিত হয়ে, প্রানের ঝুঁকি নিয়ে কয়জন মানুষ আল্লাহ্র মুত্তাকী হতে চাইবে? কয়জন মানুষ কুরআন ঐ পরিমান ভালোবাসবে যে রাতের পর রাত, দিনের পর দিন কুরআনের গবেষণায় নিজেকে নিবেদন করতে চাইবে? এমনকি যদি সুযোগও থাকে তবুও বেশিরভাগ মানুষই এতো ঝামেলা নিজের কাঁধে নিতে চায় না। তারা চায় ধর্মের ধারক বাহকরা সব রেডিমেড অর্ডার করা ফাস্টফুডের মতো তাদের মুখের কাছে এনে দেবে। নিজের বুদ্ধি, বিবেক, মন-মস্তিষ্ক খাটাতে হয় এমন কোন কাজ মানুষ করতে পছন্দ করে না। প্রয়োজনে এর দশগুন শারীরিক পরিশ্রম করবে, অর্থ উপার্জন করে টাকার স্তূপ ঢেলে দেবে মাজারে, মসজিদে, পীরের দরগায়। কিন্তু কুরআন নিয়ে ভাবনা? সেটা একদম চাই না! আর একারণেই বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির এই অত্যাধুনিক সময়ে এসেও এখনও মানুষের কুরআন বুঝতে এত অনীহা, এত অন্তরায়, এতো সমস্যা। তারা হুজুরদের তৈরি করে রাখা লক্ষ্য লক্ষ্য হাদিস, তাফসীর, শানে নুযূল, এরপর আবার ফিকাহ, মাসালা, ইজমা, কিয়াস সবই পড়তে রাজি, সেগুলো মেনে তা নিয়ে সারাজীবন দলাদলি করতেও রাজি কিন্তু কুরআনের মাত্র ৬০০০ হাজার আয়াত পড়তে তাদের বড় কঠিন, বড়ো আলস্যবোধ হয়।
কুরআন বুঝতে পদে পদে মানুষকে চ্যালেঞ্জের স্বীকার হতে হয়, বিভ্রান্ত হতে হয়, ঝামেলা পোহাতে হয় এটা অবশ্যই সত্যি। কিন্তু তা বলে মহাপবিত্র সত্তার মহাগ্রন্থ আল‑কুরান বোঝার নিরন্তর চেষ্টা থেকে আমরা যেন থেমে না যাই। আমরা যেন হাল ছেড়ে না দিই। আমরা যেন আলস্য দ্বারা আক্রান্ত হয়ে শয়তানের মুখে হাসি ফোটাবার ব্যাবস্থা না করে বসি। সেই মুত্তাকী হওয়ার তাওফিক আল্লাহ্ আমাদের সবাইকে দান করুন এবং কুরআনকে বোঝার ও ভালবাসার ক্ষমতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করুন আমাদের অন্তরে।
সূরা আল‑বাকারা, আয়াত ২
ذَٰلِكَ ٱلْكِتَـٰبُ لَا رَيْبَ ۛ فِيهِ ۛ هُدًۭى لِّلْمُتَّقِينَ ٢
This is the Book; in it is guidance sure, without doubt, to those who fear Allah;
এটা ঐ (মহান) কিতাব যাতে কোন সন্দেহ নেই, মুত্তাকীদের জন্য পথ নির্দেশ।
আলহামদুলিল্লাহি রব্বিল আল আমিন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে বুঝার মানার তৌফিক দিন, রেজোয়ান মাহমুদ ভাইকে ও ওনলি কোরান রিসার্চ ইন্টেলিজেন্স টিমকে আন্তরিক ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ আপনাদের কে