আল্লাহকে মানো রাসুলকে মানো ( ধর্মব্যবসার শুরু যেখানে)

আল্লাহকে মানো রাসুলকে মানো? কিভাবে মানবো? আশেকে রাসুল নামাজ মুসলিমের পরিচয় সংকট হাদিস

(48) আল্লাহকে মানো রাসুলকে মানো ( ধর্মব্যবসার শুরু যেখানে) পর্ব/ YouTube
https://www.youtube.com/watch?v=N4g4y0srq3Q

সালামুন আলাইকুম। সূরা আল-ইমরানের ৩২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলছেন: ‘বলো, আল্লাহকে মান্য করো এবং রাসূলকে। বস্তুত, যদি তারা বিমুখতা অবলম্বন করে, তাহলে আল্লাহ অবিশ্বাসীদের ভালোবাসেন না।’

‘আতিউল্লাহ ওয়া রাসূলাল্লাহ’ — এই আরবি বাক্যটি বহুল আলোচিত একটি বাক্য। কুরআনের বাণী-এর মানে হলো, আল্লাহকে মান্য করো এবং রাসূলকে। এই আয়াত নিয়েই যত তর্ক‑বিতর্ক ও মতবৈষম্য ঝগড়া-বিবাদ। কুরআন অনুসারীরা বলে, শুধু কুরআন মানতে হবে। আর শিয়া ও সুন্নিরা বলে, কুরআনের সাথে রাসূলের হাদীসও মানতে হবে। চলুন, একটু যৌক্তিক বিশ্লেষণ করা যাক। আসলে কী মানতে হবে?

রাসূলের হাদীস: কুরআনে আল্লাহ রাসূলকে যা বলতে বলেছেন। সাধারণত قُلْ Qul (যুক্তাক্ষর কুল লিখতে পারিনা-remove) এবং আল্লাহর কুরআনে বলা সব কথা।

মুসলিমরা হাদিস বলতে যা বুঝে: বুখারী বা অন্যান্যদের আহমদ (মুম্মাদের স:) ওফাতের দুই শত বছর পর লেখা যাতে আমি শুনেছি বা অমুকে বলেছে, যার সাথে, যে লিখেছে তার কস্মিন কালেও দেখা হয় নাই|

প্রথমেই আমরা জানতে চেষ্টা করি, এই মান্যতা আমরা কীভাবে করব? দৈনন্দিন জীবনে আমরা গুরুজনদের মান্য করি তাদের কথা, অর্থাৎ আদেশ‑নিষেধ মানার মাধ্যমে। তাহলে আমরা একমত হতে পারি যে, আল্লাহ ও রাসূলের কথা মানতেই বলা হয়েছে।

এই আয়াতে বলা হয়েছে আল্লাহকে মানার জন্য। আল্লাহর কথা কোথায় পাব? সকলেই একবাক্যে স্বীকার করবেন, কুরআনে। কুরআনে যে আল্লাহর কথা আছে, তা আমরা কীভাবে জানি? রাসূল বলেছেন, সেজন্য জানি।

এখন কুরআন আল্লাহর বাণী। রাসূলের এই কথা যদি না মানি, তাহলে আমরা একই সাথে আল্লাহকেও মানলাম না এবং রাসূলকেও মানলাম না। কারণ, আল্লাহকে মানার জন্য আল্লাহর কথা তাহলে কোথায় পাব? আল্লাহ তো আর জনে জনে এসে আদেশ‑নিষেধ করেন না। তাছাড়া, সূরা আশ‑শুরার ৫১ আয়াতে আল্লাহ বলে দিয়েছেন: “মানুষের এই যোগ্যতা নেই, এই মর্যাদা নেই যে, আল্লাহ সরাসরি তার সাথে কথা বলবেন।”

তাহলে দেখা যাচ্ছে, আল্লাহকে মানতে হলে রাসূলকেও মানতে হবে। শুধু একজনকে মানা সম্ভব না। রাসূলকে না মানলে আল্লাহকে মানা সম্ভব না, কারণ তখন আর আল্লাহর কথা পাওয়া যায় না। তাহলে দেখা গেল, কুরআন মানলেই আল্লাহ ও রাসূলকে মানা হয়।

সমস্যা এখনো শেষ হয়নি। দাবি করা হচ্ছে, রাসূলকে মানতে হলে রাসূলের সব কথা মানতে হবে, শুধু কুরআন মানলে হবে না। রাসূল তো কুরআনের বাইরে জীবনে আরও অনেক কথা বলেছেন। এখন জানতে হবে রাসূলের কথা কোনগুলো? কুরআনের বাইরে রাসূলের আর কোনো কথা আছে কিনা যা মানতে হবে?

শিয়া ও সুন্নিদের দাবি, রাসূল জীবনে অনেক আদেশ‑নিষেধ করেছেন ও উপদেশ দিয়েছেন যা কুরআনে নেই। কুরআন ব্যাখ্যা করেছেন, প্র্যাকটিক্যালি কুরআনে বর্ণিত আল্লাহর আদেশ‑নিষেধ কীভাবে পালন করতে হবে, কীভাবে আল্লাহর ইবাদত করতে হবে তা দেখিয়েছেন।

আল্লাহ ও রাসূল দুটি আলাদা সত্তা, এটা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। একজন স্রষ্টা, অন্যজন সৃষ্টি। কিন্তু আল্লাহ কুরআনে বলেছেন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলদের মধ্যে পার্থক্য না করতে। সূরা নিসার ১৫০-১৫১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলছেন: “যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি অস্বীকৃতি জ্ঞাপনকারী, তদুপরি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলদের মধ্যে পার্থক্য করতে চায় আর বলে যে, আমরা কতককে বিশ্বাস করি কিন্তু কতককে প্রত্যাখ্যান করি এবং এরই মধ্যবর্তী কোনো পথ অবলম্বন করতে চায়, প্রকৃতপক্ষে এরাই খাঁটি কাফের, সত্য প্রত্যাখ্যানকারী। আর যারা সত্য প্রত্যাখ্যানকারী, তাদের জন্য তৈরি করে রেখেছি অপমানজনক আজাব।”

স্রষ্টা ও সৃষ্টি তো এক না? পার্থক্য তো আছেই। তাহলে কিসের পার্থক্য করতে আল্লাহ নিষেধ করেছেন? সেটা জানতে হলে জানতে হবে, আল্লাহ ও রাসূলের মধ্যে কমন জিনিসটা কী? সেটা হলো বাণী বা কথা। আল্লাহর নিজস্ব কথা মানুষের কাছে পৌঁছে দেন বলেই তিনি আল্লাহর রাসূল বা বার্তাবাহক। বার্তাবাহক বা রাসূল যদি আল্লাহর কথা না বলে নিজের থেকে বানিয়ে কথা বলেন, তাহলে তিনি আর বার্তাবাহক বা আল্লাহর রাসূল থাকেন না। এ ব্যাপারে কুরআনে রাসূলকে সাবধান করা হয়েছে ৬৯ নম্বর সূরা হাক্কাহর ৪৪-৪৬ নম্বর আয়াতে। আল্লাহ বলছেন: “সে যদি আমার নামে কোনো কথা রচনা করত, তবে আমি তার ডান হাত ধরে ফেলতাম, তারপর কেটে দিতাম তার জীবন ধমনী। তোমাদের কেউ তাকে রক্ষা করতে পারত না। এটা আল্লাহভীরুদের জন্য অবশ্যই একটা উপদেশ।”

এই আয়াত পড়ে আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, রাসূল আল্লাহর কথার বাইরে কোনো কথা বা কোনো বাণী রচনা করেননি। শুধু তাই নয়, আল্লাহ আমাদেরকে সূরা নিসার ১৫০ নম্বর আয়াতে বলেছেন আল্লাহ ও রাসূলের কথার মধ্যে কোনো পার্থক্য না করতে। কিন্তু আমরা কী দেখতে পাই? আল্লাহ কুরআনে বলেছেন এক কথা, আর রাসূল হাদীসে বলেছেন আরেক কথা। আল্লাহ কুরআনে বলেছেন সূরা বাকারার ৪৮, ১২৩, ২৫৪ নম্বর আয়াতে এবং সূরা আন‘আমের ৫১ নম্বর আয়াতে যে, হাশরের মাঠে কোনো সুপারিশ চলবে না। কিন্তু আমরা হাদীসে দেখতে পাই, নবী-রাসূল, পীর‑অলি-আউলিয়া, হাফেজ‑আলেম‑ওলামা, বুজুর্গ সবাই সুপারিশ করে শত শত, হাজার হাজার মানুষকে—যাদের জন্য জাহান্নাম নির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছিল—জান্নাতে নিয়ে যাবে। সুতরাং কুরআন আর হাদীস যে এক নয়, তা যারা প্রচলিত হাদিস এবং আল্লাহর কোরান (আল্লাহর হাদিস) বুঝে পড়ে, শুধু শুনে শুনে বলে না তারা সহজেই বুঝতে পারে বা পারবে যদি আল্লাহ তাদের মন ও মস্তিস্ক তালা দিয়ে না রাখেন।

যারা এই বিষয় এখন পড়ছেন তারা একটু চিন্তা করে দেখেন যে আপনি কি নিজে পড়েছেন বা আপনার পরিচিত সবাইকে জিজ্ঞেস করে দেখেন, কেউ কি কোরান হাদিস বুঝে পড়ে? খুব সম্ভব একজনকেও পাবেন না।  আমাদেরকে সুকৌশলে বিশেষ উদ্দেশ্যে কুরআন থেকে দূরে সরিয়ে নেয়া হয়েছে যা আমাদের মস্তিষ্কে প্রোথিত হয়ে গেছে। ভেজাল খেতে খেতে আমাদের এখন নির্ভেজাল কোনো কিছু হজম হয় না তাই আমরা সত্যকে আর মানতে চাইনা।

এখন কেউ যদি বলে, কুরআনের বাইরেও রাসূলের কথা বা হাদীস আছে, তাহলে সে সরাসরি আল্লাহর কথা অমান্য করে সত্য প্রত্যাখ্যানকারী খাঁটি কাফের হয়ে গেল, কারণ সে আল্লাহ ও রাসূলের মধ্যে পার্থক্য করল।

সুতরাং আমরা এই উপসংহারে আসতে পারি, কুরআনের বাইরে রাসূলের একটি কথাও বা হাদীসও নেই এবং রাসূলের একটিও কুরআন-বহির্ভূত হাদীস মানার অর্থই হলো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের মধ্যে পার্থক্য করা।

ভাবছেন, এরপরে সকলে হাদীস ত্যাগ করবে? ভুল ভাবছেন। ‘ওহী গায়রে মাতলু’-র কী হবে? হাদীস ছাড়া কুরআনের তাফসীর বা ব্যাখ্যা কে করবে? নামাজ কীভাবে পড়ব? ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর কোথায় পাব? কুরআনের বাইরে রাসূলের কোনো হাদীস নেই, কোনো কথা নেই, কোনো বাণী নেই? হ্যাঁ, তিনি পার্সোনাল কথা বলতে পারেন—খাদিজা, রান্না হয়েছে কিনা? আজ কিন্তু কাচ্চি খেতে ইচ্ছে করছে, ভালো করে মসলা মাখিয়ে রান্না করো। বন্ধু আবু বকর, চলো বাজারে যাই, একটু ঘুরে আসি। চাচাতো ভাই আলী, তুমি কী করছো? কোথায় আছো? কোথায় যাচ্ছো? একটু বাড়িতে আসো। এগুলো তাঁর পার্সোনাল বা ব্যক্তিগত কথা। এগুলো যদি কুরআনে সংযুক্ত করা হয়, তাহলে কুরআন হয়ে যাবে ৩ হাজার পারা, ৬ লক্ষ আয়াত, ১ হাজার সূরা। সুতরাং আসমানি কিতাব বা ঐশী গ্রন্থে যা আছে, প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পুরোটাই আল্লাহর কথা, আল্লাহর কালাম, আল্লাহর রাসূলের পবিত্র মুখ নিঃসৃত বাণী। সুতরাং কুরআনের বাইরে রাসূলের কোনো হাদীস নেই। যদি থাকত, তাহলে আল্লাহ ও রাসূলের কথার মাঝে পার্থক্য হয়ে যেত এবং আমরা যদি আল্লাহ ও রাসূলের মধ্যে পার্থক্য করি, তাহলে সূরা নিসার ১৫০-১৫২ নম্বর আয়াত অনুযায়ী আমরা সত্য প্রত্যাখ্যানকারী খাঁটি কাফের হয়ে যাব।

আপনি হয়তো ভাবছেন যে, এ কথাগুলো পীর‑বুজুর্গ, আলেম‑ওলামা, মোল্লা-মৌলভীরা জানে না? অবশ্যই জানে। জানে বলেই তারা চটকদার দুটি নাম আবিষ্কার করেছে রাসূলের নিজস্ব কথা বা হাদীসকেও আল্লাহর বাণী বলে প্রচার করার জন্য। কুরআনের নাম দিয়েছে ‘ওহী মাতলু’ (যা তেলাওয়াত করা হয়) আর রাসূলের হাদীসের নাম দিয়েছে ‘ওহী গায়রে মাতলু’ (যা তেলাওয়াত করা হয় না)। এটা সুস্পষ্টভাবে একটা বিদআত, অর্থাৎ নতুন আবিষ্কার। কারণ ওহীর এমন প্রকারভেদ বা রকমভেদের কথা কুরআনে বলা নেই। কুরআনে যা নেই তা আল্লাহর বাণী নয়, একথা সকলে স্বীকার করবেন। সমগ্র কুরআন তন্নতন্ন করে ঘেঁটেও এমন নাম খুঁজে পাওয়া যায় না। যারা জুমার খুতবা শুনে থাকেন, তাদের মুখস্থ হয়ে গেছে: ‘কুল্লু বিদ‘আতিন দালালা, ওয়া কুল্লু দালালাতিন ফিন্ নার’—অর্থাৎ, ধর্মীয় সকল বিদআত বা নতুন আবিষ্কার পথভ্রষ্টতা, আর সকল পথভ্রষ্টতাই জাহান্নামে নিয়ে যাবে।

সূরা আল-ইমরানের ৩১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: “বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসো, তাহলে আমাকে অনুসরণ করো, যাতে আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসেন এবং তোমাদের পাপ মার্জনা করে দেন। আর আল্লাহ হলেন ক্ষমাশীল, দয়ালু।” আল্লাহকে ভালোবাসার সাথে কোনো আবেগ বা শারীরিক মিলনের আকাঙ্ক্ষা জড়িত নেই। যারা আল্লাহকে ভালোবাসে, তাদের কী করতে হবে তা এই আয়াতে পরিষ্কারভাবে বলা আছে। রাসূলকে অনুসরণের মাধ্যমেই আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ পায়।

অনেকেরই মনে প্রশ্ন জাগে, রাসূলকে অনুসরণ করতে হলে তো একজন জীবিত মানুষ রাসূল লাগবে? না রে ভাই, লাগবে না। রাসূল বা যেকোনো মহামানবকে আমরা অনুসরণ করি তাঁর মতো দাড়ি রেখে বা টুপি পরে বা তাঁর মতো পোশাক পরে বা লাউ খেয়ে নয়; তাঁকে অনুসরণ করি তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে মুগ্ধ হয়ে, তাঁর ভালো গুণকে অনুসরণ করে। রাসূলের চরিত্রের বর্ণনা কুরআনে দেয়া আছে, যা অনুসরণ করতে হবে। রাসূলকে অনুসরণের মানেই হলো রাসূলের মতো সত্যবাদী হওয়া, ন্যায়পরায়ণ হওয়া, পরোপকারী হওয়া, লোভ‑লালসা পরিহার করে অন্যায় করা থেকে নিজেকে বিরত রেখে পরিশুদ্ধ হওয়া, আল্লাহর শাস্তিকে ভয় করা, আল্লাহকে ছাড়া অন্য কাউকে উপাস্য না করা, অর্থাৎ মোল্লা-মৌলভী-পীর‑বুজুর্গদের মিথ্যা চটকদার প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস না করা। আল্লাহর আদেশ‑নিষেধ মেনে চললেই আল্লাহকে ভালোবাসা হবে, আল্লাহর ক্ষমা পাওয়া যাবে। ‘নামাজ বেহেশতের চাবি’, ‘হজ করলে নিষ্পাপ হয়ে যায়’ ইত্যাদি মোল্লা-মৌলভী, হুজুর, পীর‑বুজুর্গদের এমন মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে ভুললে চলবে না, কারণ এমন প্রতিশ্রুতি মহান আল্লাহ দেননি।

এরপরেও কিছু প্রশ্ন শেষ হবে না। মানলাম, কুরআনের বাইরে রাসূলের কোনো হাদীস নেই, তাহলে কে আমাদের কুরআন ব্যাখ্যা করে দেবে? কুরআনে তো কীভাবে নামাজ পড়ব তা নেই।

রাসূল যেভাবে দেখিয়েছেন, সেভাবেই তো নামাজ পড়ব। সারা দুনিয়ার মুসলমান রাসূলের বলা ব্যাখ্যা শুনেই কুরআন বুঝেছে। তিনি যেভাবে দেখিয়েছেন, সেভাবেই নামাজ পড়ে আসছে ১৪০০ বছর ধরে।

যদি তাই হয় তবে হবে খলীফারাও ওই একই ভাবে নামাজ পড়তেন, হযরত আলী-ও পড়াতেন তাহলে শিয়া এবং সুন্নিদের নামাজে কোনো পার্থক্য পাওয়া যেত না কিন্তু বাস্তবে শিয়ারা অন্যভাবে নামাজ পড়ে এবং আজানও দেয়। এতেই প্রমাণিত হয় নামাজ এবং আজান নবী দিয়ে যান নি, ক্ষমতাধর মানুষদের বানানো, নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে, সাথে আছে শয়তানের প্ররোচনা, যাতে দুনিয়ার মানুষ সুখে না থেকে সবসমই অশান্তিতে থাকে এবং মানুষদের মধ্যে যেন একতা না আসে, সেই সাথে একগোত্রের মানুষ কমজানা এবং সরল মানুষদের ধোকা দিয়ে টাকা পয়সা কামিয়ে নিতে পারে এবং এরা এখনো একই প্রচারণা করে যাচ্ছে এবং ধোকা দিয়ে যাচ্ছে এবং এই সহজ সত্য কে মানছে না , ইচ্ছা করেই মানছে না, মানলে তো কাজ করে চলতে হবে, শান নিয়ে,  ক্ষমতা নিয়ে চলা যাবে না।

এখন প্রশ্ন হলো, রাসূল কি আসলেই কুরআন ব্যাখ্যা করে গেছেন? রাসূল কি আসলেই নামাজ কীভাবে পড়তে হবে তা দেখিয়ে গেছেন? কুরআন কী বলে?

আল্লাহকে মান্য করা আর রাসূলকে মান্য করা একই কথা। এই মান্য করার ক্ষেত্রে আমাদের ভিত্তি হলো পবিত্র কুরআন, যাতে লিপিবদ্ধ আছে আল্লাহর আদেশ‑নিষেধ এবং এটাই রাসূলের মুখ নিঃসৃত কথা, কারণ রাসূল বলেছেন কুরআন আল্লাহর বাণী। আল্লাহ ও রাসূলের কথা বা হাদীসের মাঝে কোনো পার্থক্য করা যাবে না, এটাও আল্লাহ পাকের নির্দেশ। আল্লাহর এই পরিষ্কার নির্দেশের পরেও পীর‑বুজুর্গরা রাসূলের নামে প্রচলিত হাদীস বর্জন করেন না এই বলে যে, রাসূলের হাদীসে কুরআনের ব্যাখ্যা আছে। আসলেই কি রাসূলকে কুরআন ব্যাখ্যা করার দায়িত্ব আল্লাহ দিয়েছেন? রাসূলের কোনো ব্যাখ্যা থেকে থাকলে এটা তো তাঁর নিজস্ব কথা বা রচনা হয়ে যাবে! এমনটা করতে আল্লাহ রাসূলকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন ৬৯ নম্বর সূরার ৪৪-৪৬ নম্বর আয়াতে: “সে যদি আমার নামে কোনো কথা রচনা করত, তবে আমি তার ডান হাত ধরে ফেলতাম, তারপর কেটে দিতাম তার জীবন ধমনী। তোমাদের কেউ তাকে রক্ষা করতে পারতো না। এটা খোদাভীরুদের জন্য অবশ্যই একটা উপদেশ।”

কুরআন নিজেই নিজের ব্যাখ্যা এবং আল্লাহ রাসূলকে জিহ্বা নাড়াতে নিষেধ করেছেন, অর্থাৎ ব্যাখ্যা করতে নিষেধ করেছেন ৭৫ নম্বর সূরার ১৭-১৯ নম্বর আয়াতে: “এর সংরক্ষণ ও পাঠ আমারই দায়িত্ব। অতঃপর আমি যখন তা পাঠ করি, তখন তুমি সেই পাঠের অনুসরণ করো। এরপর এর বিস্তারিত বর্ণনাও আমারই দায়িত্ব।” তাহলে কুরআনের ব্যাখ্যা কোথায় পাব? দেখি আল্লাহ কী বলেছেন।

সূরা নাহলের ৮৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: “আমি আপনার প্রতি কিতাব নাযিল করেছি, যেটি এমন যে, তা সবকিছুর সুস্পষ্ট বর্ণনা, হেদায়েত, রহমত এবং মুসলিমদের জন্য সুসংবাদ।” আল্লাহ নিজেই বলছেন, কুরআন হচ্ছে ‘তিব্ইয়ানা লিকুল্লি শাই’—অর্থ সবকিছুর বর্ণনা, ব্যাখ্যা। কুরআনের আরও বহু আয়াতে আল্লাহ বারে বারে বলেছেন, কুরআন সুস্পষ্ট, বক্রতামুক্ত, পূর্ণ।

“আলিফ‑লাম‑রা। এটি এমন এক কিতাব, যার আয়াতসমূহ সুপ্রতিষ্ঠিত, অতঃপর সবিস্তারে বর্ণিত এক মহাজ্ঞানী, সর্বজ্ঞ সত্তার পক্ষ হতে।” (সূরা হুদ, আয়াত: ১)

“আর কুরআন সে জিনিস নয় যে, আল্লাহ ব্যতীত কেউ তা বানিয়ে নেবে। অবশ্যই এটি পূর্ববর্তী কালামের সত্যায়ন করে এবং সে সমস্ত বিষয়ের বিশ্লেষণ‑ব্যাখ্যা দান করে যা তোমার প্রতি দেয়া হয়েছে, যাতে কোনো সন্দেহ নেই, তোমার বিশ্ব পালনকর্তার পক্ষ থেকে।” (সূরা ইউনুস, আয়াত: ৩৭)

আল্লাহ নিজেই কুরআনের শিক্ষক এবং কুরআন পরিষ্কার আরবি ভাষায় নাযিল হয়েছে। যে কারণে কুরআন বোঝার জন্য আরবিতে পিএইচডি ধারী বিশেষজ্ঞ বা টাইটেল পাস মাওলানা হওয়া দরকার নেই। আল্লাহর সাহায্য কামনা করে কুরআন বুঝে পড়ার ইচ্ছাই যথেষ্ট। কুরআনের বহু অনুবাদ বাজারে বিদ্যমান।

“করুণাময় আল্লাহ শিক্ষা দিয়েছেন কুরআন।” (সূরা আর‑রাহমান, আয়াত: ১‑২)
“আমি একে আরবি ভাষায় কুরআন রূপে অবতীর্ণ করেছি, যাতে তোমরা বুঝতে পারো।” (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ২)
“আমি এই কুরআনে নানাভাবে বুঝিয়েছি, যাতে তারা চিন্তা করে। অথচ এতে তাদের কেবল বিমুখতাই বৃদ্ধি পায়।” (সূরা বনি-ইসরাইল, আয়াত: ৪১)
“আমি এই কুরআনে মানুষকে বিভিন্ন উপমা দ্বারা সব রকম বিষয়বস্তু বুঝিয়েছি, কিন্তু অধিকাংশ লোক অস্বীকার না করে থাকেনি।” (সূরা বনি-ইসরাইল, আয়াত: ৮৯)
“আমি কুরআনকে আপনার ভাষায় সহজ করে দিয়েছি, যাতে আপনি এর দ্বারা পরহেজগারদেরকে সুসংবাদ দেন এবং কলহকারী সম্প্রদায়কে সতর্ক করেন।” (সূরা মারইয়াম, আয়াত: ৯৭)

এরপরেও যারা বলে রাসূলের হাদীস কুরআনের ব্যাখ্যা, তারা কি আল্লাহর বাণীকে অস্বীকার করছে না? তাহলে নামাজ কীভাবে পড়ব?


(48) রাসুল মানার পদ্ধতি কি?? আল্লাহকে মানো রাসুলকে মানো পর্ব+/ YouTube
https://www.youtube.com/watch?v=PulgPjrkqOw

(48) রাসুল কি দেন? ( আল্লাহকে মানো রাসুলকে মানো পর্ব/) YouTube
https://www.youtube.com/watch?v=QRNVdf0qT‑s

শুধু কুরআনকে অনুসরণ করলেই যদি আল্লাহ ও রাসূলকে মান্য করা হয় এবং কুরআনের বাইরে যদি রাসূলের কোনো কথা না থাকে, তাহলে আমরা নামাজ কীভাবে পড়ব? কুরআনে তো নামাজ কীভাবে পড়তে হয় তা বলা নেই। আল্লাহ কি ভুলে গেছেন এত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত কখন কীভাবে করতে হবে তা বলতে?

অযু করো, আল্লাহু আকবার বলে হাত কান পর্যন্ত তুলে বুকে হাত বেঁধে কিবলামুখী হয়ে দাঁড়াও, সানা পড়ো, সূরা ফাতিহা পড়ো, তারপরে একটি সূরা বা অন্তত তিনটি আয়াত পড়ো, তারপরে আল্লাহু আকবার বলে হাঁটুতে হাত দিয়ে কোমর বাঁকিয়ে রুকু করো, রুকুতে তিনবার ‘সুবহানা রাব্বিয়াল আযীম’ বলো, ‘সামি আল্লাহু লিমান হামিদা’ বলে দাঁড়াও, তারপরে আল্লাহু আকবার বলে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে দুইবার সিজদা করো, আবার আল্লাহু আকবার বলে উঠে দাঁড়াও—এটা এক রাকাত। এভাবে ফজরে দু‘রাকাত, যোহরে, আসরে আর এশায় চার রাকাত করে আর মাগরিবে তিন রাকাত নামাজ পড়বে—এই কথা কয়টি বলতে তো এক পাতার বেশি লাগার কথা না। কিন্তু না, আল্লাহ এসব কিছুই কুরআনে বলেননি। অথচ সূরা আন‘আমের ৩৮ নম্বর আয়াতে ঠিকই বলে দিয়েছেন: “আমি কিতাবে কিছুই বাদ দেইনি।” তাহলে কি আল্লাহ মিথ্যে বলছেন?

আল্লাহ কুরআনে নামাজের বিস্তারিত বিবরণ বলেননি তো কী হয়েছে? হুজুর‑মোল্লাদের তাৎক্ষণিক জবাব: না, আল্লাহ ভুলে যাননি। তিনি জিব্রাইলের মাধ্যমে রাসূলকে শিখিয়েছেন কীভাবে নামাজ পড়তে হবে, তারপরে রাসূল দেখিয়েছেন কীভাবে নামাজ পড়তে হবে। এরপরে আর কথা থাকে না। কিন্তু সমস্যা হলো, কুরআনে এমন কোনো আয়াত খুঁজে পাওয়া যায় না যেখানে আল্লাহ বলেছেন, ‘রাসূল দেখিয়ে দেবেন কীভাবে নামাজ পড়তে হবে বা ইবাদত করতে হবে’।

খুবই সহজ হিসাব: সালাত নামাজ নয়। কুরআনই সম্পূর্ণ, বিস্তারিতভাবে বর্ণিত একমাত্র আসমানি কিতাব, একমাত্র বিধান। কোনো হাদীসের প্রয়োজন নেই। সুতরাং যদি নামাজ নামক প্রার্থনাটির বর্ণনা কুরআনে বর্ণিত না থাকে, তবে আল্লাহ আমাদেরকে এমন একটি আনুষ্ঠানিক প্রার্থনা করার নির্দেশ দিচ্ছেন না। সালাত হলো যোগাযোগ, সাহায্য, সহযোগিতা এবং কোনো কিছুর প্রতি শতভাগ মনোযোগ (Con­cen­tra­tion) প্রদান করা। এটা ‘দরুদ শরীফের’ ভিডিওতে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। তাছাড়া ‘নামাজ এবং সালাত’ সিরিজে ডিটেইলস বর্ণিত হয়েছে, আপলোড করা আছে। আপনার যদি কোনো আত্মীয়-স্বজন আরবের কোনো দেশে থাকে, তাহলে তাকে জিজ্ঞেস করে দেখবেন যে, আরবের যোগাযোগ মন্ত্রণালয় (Telecom­mu­ni­ca­tion Ministry)-এর সাথে ‘সালাত’ শব্দটা যুক্ত থাকে।

সুতরাং আল্লাহ রাসূলের মাধ্যমে বাণী পাঠিয়ে মানুষের সাথে সালাত বা যোগাযোগ করেন, আর সেই বাণীটি হলো কুরআন। সালাত কায়েম করার অর্থ হলো, যোগাযোগের মাধ্যমে পাওয়া কুরআনে বর্ণিত সকল বিধান বিনয়ের সাথে (মানে রুকুর সাথে; রুকু নিয়ে বিস্তারিত ভিডিও আছে) মেনে নিয়ে (মানে সিজদা করে; সিজদা নিয়েও তিন পর্বের বিস্তারিত ভিডিও আছে) নিজের ও অন্যের জীবনে প্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে ‘আকিমুস সালাত’। আপনি যদি সত্যবাদী, ন্যায়পরায়ণ, দানশীল না হন, তাহলে আপনি সিজদা করলেন না, অর্থাৎ আল্লাহর আদেশ‑নিষেধ মেনে নিলেন না। আল্লাহর আদেশ‑নিষেধ জানতে কুরআন বুঝে পড়তে হবে আপনাকে। আল্লাহর আদেশ‑নিষেধ পালনই ইবাদত।

সূরা নিসার ৬১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: “আর যখন আপনি তাদেরকে বলবেন, আল্লাহর নির্দেশের দিকে এসো যা তিনি রাসূলের প্রতি নাযিল করেছেন, তখন আপনি মুনাফিকদের দেখবেন, ওরা আপনার কাছ থেকে সম্পূর্ণভাবে সরে যাচ্ছে।”

হাদীসে মোল্লারা যা পছন্দ করে, তাই আছে। কুরআনের পাশাপাশি হাদীস রচনা করে আল্লাহর সাথে মোল্লারা রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। এরপরেও যারা কুরআন-বহির্ভূত হাদীস আঁকড়ে থাকতে চায়, তাদের কাছে জিজ্ঞাসা, ৬৮ নম্বর সূরার ৩৭-৩৮ নম্বর আয়াতে: “তোমাদের কাছে কি কোনো কিতাব আছে যা তোমরা পাঠ করো? তাতে তোমরা যা পছন্দ করো, তাই পাও?”

কুরআনের বাণী বা বার্তা ছাড়া রাসূল কেবলই একজন সাধারণ মানুষ। আল্লাহ রাসূলকে কী প্রচার করতে বলেছেন? ৪১ নম্বর সূরার ৬ নম্বর আয়াতে: “বলুন, আমিও তোমাদের মতোই মানুষ। আমার প্রতি ওহী আসে যে, তোমাদের ইলাহ একমাত্র ইলাহ। অতএব, তাঁর দিকেই সোজা হয়ে থাকো এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। আর মুশরিকদের জন্য রয়েছে দুর্ভোগ।”

৮০ নম্বর সূরার ১‑১১ আয়াতে বলা হয়েছে: “তিনি ভ্রু কুঞ্চিত করলেন এবং মুখ ফিরিয়ে নিলেন, কারণ তাঁর কাছে এক অন্ধ আগমন করেছে। আপনি কি জানেন, সে হয়তো পরিশুদ্ধ হতো অথবা উপদেশ গ্রহণ করত এবং উপদেশে তার উপকার হতো। উপরন্তু, যে বেপরোয়া, আপনি তার চিন্তায় মশগুল। সে শুদ্ধ না হলে আপনার কোনো দোষ নেই। যে আপনার কাছে দৌড়ে আসলো এমতাবস্থায় যে সে ভয় করে, আপনি তাকে অবজ্ঞা করলেন। কখনো এরূপ করবেন না। এটা উপদেশবাণী।”

যখন তাঁর কেবল আল্লাহকে ভয় করার কথা ছিল, তখন তিনি মানুষকে ভয় করেছিলেন। ৩৩ নম্বর সূরা, ৩৭ নম্বর আয়াত: “আল্লাহ যাকে অনুগ্রহ করেছেন, আপনিও যাকে অনুগ্রহ করেছেন, তাকে যখন আপনি বলেছিলেন, ‘তোমার স্ত্রীকে তোমার কাছেই থাকতে দাও এবং আল্লাহকে ভয় করো।’ আপনি অন্তরে এমন বিষয় গোপন করেছিলেন যা আল্লাহপাক প্রকাশ করে দেবেন। আপনি মানুষের নিন্দার ভয় করেছিলেন, অথচ আল্লাহকেই অধিক ভয় করা উচিত। অতঃপর যায়েদ যখন জয়নবের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করল, তখন আমি তাকে আপনার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করলাম, যাতে মুমিনদের পোষ্যপুত্ররা তাদের স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলে সেসব স্ত্রীকে বিবাহ করার ব্যাপারে মুমিনদের কোনো অসুবিধা না থাকে। আল্লাহর নির্দেশ কার্যে পরিণত হয়েই থাকে।”

এবং আল্লাহ যা নিষেধ করেননি, তা (তিনি) নিষিদ্ধ করেছেন। ৬৬ নম্বর সূরা, ১ নম্বর আয়াত: “হে নবী, আল্লাহ আপনার জন্য যা হালাল করেছেন, আপনি আপনার স্ত্রীদেরকে খুশি করার জন্যে তা নিজের জন্য হারাম করেছেন কেন? আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়াময়।”

এ কারণেই ‘মোহাম্মদের আনুগত্য করো’ বলা হয়নি কুরআনে, ‘রাসূলের আনুগত্য করতে’ বলা হয়েছে। কারণ আল্লাহর কথা আর রাসূলের কথা একই, কোনো পার্থক্য নেই। আমরা যদি মানবসত্তা মোহাম্মদের আনুগত্য করি, তবে আমরা গরীবদের প্রতি ভ্রু কুঞ্চিত করব, আমরা আল্লাহর পরিবর্তে মানুষকে ভয় করব এবং আল্লাহ যা নিষেধ করেননি তা নিষিদ্ধ করব (৬৬:১, ৩৩:৩৭, ৮০:১‑১১)। আমাদের রাসূলের আনুগত্য করা আবশ্যক, ব্যক্তি মোহাম্মদকে নয়।

৫৯ নম্বর সূরার ৭ নম্বর আয়াতটা অত্যন্ত বিখ্যাত: “রাসূল তোমাদেরকে যা দেন তা গ্রহণ করো।” (সূরা হাশর, আয়াত ৭)। রাসূলকে মান্য করার নামে সুন্নি ও শিয়ারা প্রায়ই কুরআন-বহির্ভূত, রাসূলের নামে প্রচলিত হাদীসের সমর্থনে যে দুটি আয়াতের উদ্ধৃতি দিয়ে থাকে, তার আরেকটি হচ্ছে এই ৫৯ নম্বর সূরার ৭ নম্বর আয়াত। যার পুরো আয়াতে বলা আছে: “আল্লাহ জনপদবাসীদের কাছ থেকে তাঁর রাসূলকে যা দিয়েছেন, তা আল্লাহর, রাসূলের, তাঁর আত্মীয়-স্বজনের, ইয়াতিমদের, অভাবগ্রস্তদের এবং মুসাফিরদের জন্য, যাতে ধন-ঐশ্বর্য কেবল তোমাদের বিত্তশালীদের মধ্যেই পুঞ্জীভূত না হয়। রাসূল তোমাদেরকে যা দেন তা গ্রহণ করো এবং যা নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাকো এবং আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা।”

মোল্লা-মৌলভী, হুজুররা ইচ্ছাকৃতভাবে সম্পূর্ণ আয়াতটি বলে না, গোপন করে। কারণ তাহলে তাদের জারিজুরি ফাঁস হয়ে যাবে। আমরা যদি এই আয়াতটি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ি, তাহলে নিজেরাই বুঝে যাব রাসূল কী দিয়েছেন আর কী নিষেধ করেছেন। দেখতে পাব যে, রাসূলের দেয়ার নামে হুজুররা যে সকল কুরআন-বহির্ভূত হাদীস আমাদের গত ১৪০০ বছর ধরে গিলিয়েছেন, সে সম্পর্কে কিছুই এই আয়াতে নেই।

যারা এভাবে কুরআনের আয়াত গোপন করে, আল্লাহর নামে ও রাসূলের নামে মিথ্যা হাদীস প্রচার করে ইসলাম ধর্মকে বিকৃত করে, ধর্মকে তাদের জীবিকা বানায়, তাদের সম্পর্কে আল্লাহ আগেই সাবধান করেছেন। সূরা বাকারার ৭৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: “অতএব, তাদের জন্য আফসোস, যারা নিজের হাত দিয়ে কিতাব লেখে এবং বলে, ‘এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ’, যাতে এর বিনিময়ে সামান্য অর্থ গ্রহণ করতে পারে। অতএব, তাদের প্রতি আক্ষেপ তাদের হাতের লেখার জন্য এবং তাদের প্রতি আক্ষেপ তাদের উপার্জনের জন্য।”

সূরা বাকারার ১৫৯ নম্বর আয়াত: “নিশ্চয়ই যারা গোপন করে আমি যেসব বিস্তারিত তথ্য এবং হেদায়েতের কথা নাযিল করেছি মানুষের জন্য কিতাবের মধ্যে বিস্তারিত বর্ণনা করার পরও, সে সমস্ত লোকের প্রতি আল্লাহর অভিশাপ এবং অন্যান্য অভিশাপকারীদেরও।”

সূরা বাকারার ১৭৪ নম্বর আয়াত: “নিশ্চয়ই যারা সেসব বিষয় গোপন করে যা আল্লাহ কিতাবে নাযিল করেছেন এবং সেজন্য অল্পমূল্য গ্রহণ করে, তারা আগুন ছাড়া নিজের পেটে আর কিছুই ঢোকায় না। আর আল্লাহ কিয়ামতের দিন তাদের সাথে কথা বলবেন না, না তাদের পবিত্র করবেন। বস্তুত, তাদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক আজাব।”

‘যারা রাসূলের হাদীস অস্বীকার করে তারা কাফের’—হুজুরদের কল্যাণে এ কথাটি আজ আমাদের আপামর জনতার মুখস্থ হয়ে গেছে। আমরা যারা কুরআন অনুসারী ও রাসূলের নামে বানানো সকল হাদীস অস্বীকারকারী, তারা কি আসলেই কাফের? নাকি হুজুররা নিজেদের রবের আসনে বসিয়ে এমন বিধান জারি করে আল্লাহর সাথে শিরক করছে? চলুন দেখি কুরআন কী বলে।

সারা কুরআন খুঁজেও রাসূলেরও যে নিজস্ব হাদীস আছে, তা কোথাও খুঁজে পেলাম না। হুজুরদের কাছে এমন কোনো আয়াত থাকলে দেখিয়ে দিলে বাধিত হব। কুরআনে দুই ধরনের হাদীসের কথা বলা হয়েছে: প্রথমটি হলো ‘আহসানাল হাদীস’, আর দ্বিতীয়টি হলো ‘লাহওয়াল হাদীস’।

‘আহসানাল হাদীস’: সর্বশক্তিমান আল্লাহ, যিনি সমস্ত কিছু তৈরি করেছেন, তিনি আমাদের নির্দেশের জন্য কুরআন দিয়েছেন, আর কিছুই না। ‘হাদীস’ শব্দটি তিনি তাঁর কুরআনে মোট ৩৬ বার উল্লেখ করেছেন, কিন্তু একবারও বলেননি কুরআনের বাইরে রাসূলের নিজস্ব হাদীস আছে। হাদীসের অর্থ: কথা, বাণী, বক্তৃতা, গল্প, ইঙ্গিত। চলুন দেখি আল্লাহ কোনটাকে ‘আহসানাল হাদীস’ বলেছেন। ৩৯ নম্বর সূরা জুমারের ২৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: “আল্লাহ উত্তম বাণী তথা ‘আহসানাল হাদীস’ নাযিল করেছেন, যা সামঞ্জস্যপূর্ণ, পুনঃপুনঃ পঠিত। এতে তাদের লোম কাঁটা দিয়ে ওঠে চামড়ার ওপর, যারা তাদের পালনকর্তাকে ভয় করে। এরপর তাদের চামড়া ও অন্তর আল্লাহর স্মরণে বিনম্র হয়। এটাই আল্লাহর পথনির্দেশ। এর মাধ্যমে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথ প্রদর্শন করেন। আর আল্লাহ যাকে গোমরাহ করেন, তার কোনো পথপ্রদর্শক নেই।”

এই আয়াত থেকে জানলাম, আল্লাহর কিতাব এই কুরআনই হলো ‘আহসানাল হাদীস’। শুধু তাই নয়, তিনি আরও বলেছেন, আল্লাহর হাদীসের চেয়ে সত্য হাদীস আর কিছুই হতে পারে না। সূরা নিসার ৮৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: “আল্লাহ ব্যতীত আর কোনোই উপাস্য নেই। অবশ্যই তিনি তোমাদেরকে সমবেত করবেন কিয়ামতের দিন, এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। তাছাড়া আল্লাহর চাইতে বেশি সত্য হাদীস আর কার হবে?” এক কথাই শেষ নয়, কুরআনের আয়াতের বাইরে আর কোনো হাদীসে বিশ্বাস করতে নিষেধ করেছেন। ৪৫ নম্বর সূরা, ৬ নম্বর আয়াত: “এগুলো আল্লাহর আয়াত যা আমি আপনার কাছে আবৃত্তি করি যথাযথরূপে। অতএব, আল্লাহ ও তাঁর আয়াতের পরে তারা কোন হাদীসে বিশ্বাস স্থাপন করবে?”

‘লাহওয়াল হাদীস’: কুরআন হলো ‘আহসানাল হাদীস’ বা উত্তম বাণী সমৃদ্ধ কিতাব। এতেই আছে প্রয়োজনীয় সকল ধর্মীয় নির্দেশ। এর বাইরে যত ধর্মীয় নির্দেশ আছে, তা রাসূলের হাদীসই হোক বা হুজুরদের ফতোয়াই হোক, সবই ‘লাহওয়াল হাদীস’ বা অসার কথা। এর উদ্দেশ্যই হলো কুরআনের পথ থেকে মানুষকে দূরে রাখা। ৩১ নম্বর সূরা, ৬ নম্বর আয়াত: “এক শ্রেণির লোক আছে যারা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে গোমরাহ করার উদ্দেশ্যে ‘লাহওয়াল হাদীস’ ক্রয় করে কোনো জ্ঞান ছাড়াই এবং উহাকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করার জন্য। এদের জন্য রয়েছে অবমাননাকর শাস্তি।”

হাদীস দিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ কীভাবে করে? কিছুদিন আগে একটা ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল। আব্বাসী হুজুর এক কুরআনের ভাইকে দাওয়াত দিয়ে কুকুর দিয়ে আপ্যায়ন করতে চেয়েছিল। হুজুরের দাবি, রাসূল কুকুর হারাম করেছেন, আর কুরআনে কুকুর হারাম বলা নেই। আল্লাহ যা হারাম করেননি, তা হারাম করার অধিকার কারো নেই, এমনকি রাসূলেরও নেই। আল্লাহ নবীকে তিরস্কার করেছেন হালালকে হারাম করার জন্য ৬৬ নম্বর সূরা তাহরিমের ১ নম্বর আয়াতে। কুকুর আমরা খাই না, আমাদের রুচিতে বাঁধে, ঘেন্না লাগে, তাই হয়তো খাই না। কিন্তু একথা বলতে পারি না, ‘কুকুর খাওয়া হারাম’। কোরিয়ান, ভিয়েতনামী মুসলিমরা আগ্রহের সাথে কুকুরের মাংস খায়। তাদের তো আর বলা যাবে না ‘কুকুর হারাম’।

‘লাহওয়াল হাদীস’-এর অনুসারীদের কাছে কুরআনের আয়াত পড়ে শোনানো হলে তাদের প্রতিক্রিয়া কী হবে, তা কুরআনে ভবিষ্যৎবাণী করা আছে। আমরা আজও যখন শুধু কুরআন মেনে চলার কথা বলি, তখন হুজুরদের মধ্যে একই প্রতিক্রিয়া দেখি। ৩১ নম্বর সূরা, ৭ নম্বর আয়াত: “যখন ওদের সামনে আমার আয়াতসমূহ পাঠ করা হয়, তখন ওরা দম্ভের সাথে এমনভাবে মুখ ফিরিয়ে নেয়, যেন ওরা তা শুনতেই পায়নি অথবা যেন ওদের দু‘কান বধির। সুতরাং ওদেরকে কষ্টদায়ক, যন্ত্রণাদায়ক আজাবের সংবাদ দাও।”

কুরআনে আল্লাহ কাফেরদেরকে বলেছেন ৫২ নম্বর সূরার ৩৪ নম্বর আয়াতে: “তাহলে তারা এই কুরআনের মতো একটা হাদীস পেশ করুক, যদি তারা সত্য বলে থাকে।” পরিহাসের বিষয় হলো, কাফেররা নয়, বরং ইমাম বুখারী এবং তাঁর বন্ধুরা আল্লাহর কাছ থেকে এই চ্যালেঞ্জের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছে। যেই চ্যালেঞ্জ আল্লাহ ৫২ নম্বর সূরার ৩৪ নম্বর আয়াতে দিয়েছেন। তারা রাসূলের নামে ‘লাহওয়াল হাদীস’ সংগ্রহ করেছে, এমনকি ‘হাদীসে কুদসি’ ধারণা তৈরি করেছে। ইমাম বুখারী এবং তাঁর বন্ধুদের মতানুসারে, ‘হাদীসে কুদসি’ হলো আসলে কুরআনের অপ্রকাশিত আয়াত। এভাবেই তারা আল্লাহর চ্যালেঞ্জের উত্তর দিতে সাহসিকতার সাথে উঠে এসেছে।

মুসলিমদের যে হাদীসগুলো কোরআনের সাথে মেলে সেগুলো গ্রহণ, আর যেগুলো অবাস্তব ও কোরআনের সাথে মেলে না সেগুলো বর্জন করার অনুমতি আছে কি? আজকাল অনেককে বলতে শুনি: ‘ভাই, আমি সব হাদীস অস্বীকার করি না, যেগুলো কুরআনের সাথে মেলে সেগুলো মানি।’ এদের অবস্থা: শ্যাম রাখি না কুল রাখি। কুরআনের পরিষ্কার নির্দেশ উপেক্ষা করতে পারছে না, আবার এতদিনের বিশ্বাসও ত্যাগ করতে পারছে না। তার উপর কাফের ঘোষিত হয়ে সমাজচ্যুত হওয়ার ভয়ও আছে। কুরআনের সাথে যদি মেলেই, তাহলে আর হাদীসের কী প্রয়োজন? কুরআন কি যথেষ্ট নয়?

রাসূলের নামে প্রচলিত হাদীসে বিশ্বাসীরা সকলেই একবাক্যে বলবে, ‘আমরা কুরআন বিশ্বাস করি। কুরআন আমাদের জন্য যথেষ্ট।’ এটা ওদের মুখের কথা। বাস্তবে এরা কুরআন বিশ্বাস করে না। এরা কি এই আয়াতগুলো বিশ্বাস করে? সতর্কবার্তা: কুরআনের অনুবাদে আরবিতে ‘হাদীস’ শব্দটির বাংলা অনুবাদ করেছে ‘কথা’, ‘বাণী’, ‘বার্তা’। আবার রাসূলের কথাবার্তাকে বলে থাকে ‘রাসূলের হাদীস’। সেখানে তারা ঠিকই আরবি শব্দ ‘হাদীস’ প্রয়োগ করে, বাংলায় ‘কথা’ বা ‘বার্তা’ বলে না। আবার রাসূলকে যদি কেউ বলে ‘বার্তাবাহক’, তাহলে মনে মনে সম্ভবত খুব কষ্ট পায়।

“অতএব, আল্লাহ ও তাঁর আয়াতের পর তারা আর কোন হাদীসে বিশ্বাস স্থাপন করবে?” (সূরা আল‑জাছিয়া, আয়াত: ৬)
“বস্তুত, এরপর কোন হাদীসের উপর ঈমান আনবে তারা?” (সূরা আল‑আ‘রাফ, আয়াত: ১৮৫)
“এখন কোন হাদীসে এরপর তারা বিশ্বাস স্থাপন করবে?” (সূরা আল‑মুরসালাত, আয়াত: ৫০)

মুসলিমদের রাসূলের হাদীসের মতো এমন একটা কিতাব অনুসরণ করার অনুমতি দেওয়া হয় না যেখান থেকে তারা তাদের পছন্দ অনুযায়ী কোনো বিবৃতি বা আইন বা যা অনুসরণ করতে চায় তা বেছে নিতে পারে। এমনকি বুখারী, মুসলিম বা সিহাহ সিত্তাহ হাদীস মানার অর্থই হলো কুরআনের আয়াত অস্বীকার করা তথা আল্লাহর পরিষ্কার নির্দেশ অবজ্ঞা করা। ৬৮ নম্বর সূরা, ৩৬-৩৮ আয়াত: “তোমাদের কী হলো? এ তোমাদের কেমন বিচার? তোমাদের কাছে কি কোনো কিতাব আছে যা তোমরা পাঠ করো? তাতে তোমরা যা পছন্দ করো, তাই পাও?”

রাসূলের আনুগত্য করতে যেয়েই খ্রিস্টানরা যীশুকে আল্লাহর পুত্র বানিয়ে গির্জায় উপাসনা করে বা মুসলিমরা রাসূলের হাদীস ও সুন্নাহ মেনে মসজিদে নামাজ পড়ে বা আলীকে ইমাম মেনে ইসলাম ধর্মে বিভক্তি এনেছে বা পীরদের আল্লাহর খাস বন্ধু, পেয়ারা দোস্ত মেনে তাদের কবর জিয়ারত করে বা বর্তমানে রাসূল দাবিদারদের পায়ে আদম সেজদা করে। কেন এমনটা করে? মানুষের স্বভাবই হলো ভেড়ার মতো। রাখাল যেমন ভেড়ার পালকে লাঠি হাতে প্রতিদিন তাড়িয়ে চড়াতে নিয়ে যায় এবং দিন শেষে আবার পথ দেখিয়ে বাড়ি নিয়ে আসে, তেমনি এদের দরকার একজন জীবন্ত মানুষ রাখাল অথবা মানুষ রাসূল অথবা ইমাম, নেতা, পীর বা হুজুর, যে এদেরকে হাত ধরে টেনে টেনে বেহেশতে নিয়ে যাবে। আমাদেরকে রাখালের মতো তাড়িয়ে নেয়াকে আরবিতে বলে ‘রাইনা’। আল্লাহ রাসূলদেরকে ‘রাইনা’ বলতে নিষেধ করেছেন। রাসূলরা ‘রাইনা’ নয়। তাদেরকে আমাদের প্রতি লক্ষ্য রাখতে বলেছেন—‘উনযুরুনা’, অর্থাৎ আমাদের তাঁর কথা শুনতে বলেছেন এবং সেই মতো চলছে কিনা তা লক্ষ্য করতে বলেছেন। সূরা বাকারা, আয়াত ১০৪: “হে মুমিনগণ, তোমরা ‘রাইনা’ বলো না, ‘উনযুরনা’ বলো এবং শুনতে থাকো। আর কাফেরদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি।”

এখনো অনেকে রাসূল খুঁজে বেড়ায় এবং সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কেউ নিজেই রাসূল সেজে বসে, আবার কেউ কুরআন‑হাদীসের পণ্ডিত সেজে ধর্মের শিক্ষক বনে। শিক্ষকতা ও ওয়াজ মাহফিলের নামে পেট ভর্তি করে। নতুন কোনো রাসূল বা শিক্ষকের দরকার আছে কি? নতুন কোনো রাসূল আসলে কি আমাদের নতুন কোনো শিক্ষা দেবে? নাকি কুরআনের গবেষণা করে নতুন কোনো আল্লাহর বিধান বের করবে? না রে ভাই, আল্লাহর বিধান আদম থেকে আজ পর্যন্ত একই ছিল, আছে এবং থাকবে। সব ধর্মের মূলেও এই একই বিধান। নতুন কোনো রাসূল আসলেও সেই একই বিধানই দেবে: সত্য বলুন, ন্যায়পরায়ণ থাকুন, পরোপকার করুন; না পারলে অন্তত কারো ক্ষতি করবেন না। মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার করুন, বিপদে-আপদে সাহায্য করুন, কখনো জুলুম করবেন না, ঘুষ খাবেন না, সুদ খাবেন না ইত্যাদি। সুতরাং নতুন রাসূল আসলেও লাভ নেই। আল্লাহর এই বিধান অপরিবর্তিত থাকবে। আপনার এই সকল গুণাবলীর উপরে করা কার্যের বিচার পরকালে হবে। আপনি হিন্দু নাকি মুসলিম, নাকি খ্রিস্টান, নাকি ইহুদি—এ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হবে না।

৪১ নম্বর সূরা, ৪৩ নম্বর আয়াত: “আপনাকে তো তাই বলা হয় যা বলা হতো পূর্ববর্তী রাসূলগণকে। নিশ্চয়ই আপনার পালনকর্তার কাছে রয়েছে ক্ষমা এবং রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।”
৪২ নম্বর সূরা, ১৪ নম্বর আয়াত: “তাদের কাছে জ্ঞান আসার পরেই তারা পারস্পরিক বিভেদের কারণে মতভেদ করেছে। যদি আপনার পালনকর্তার পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অবকাশের পূর্ব সিদ্ধান্ত না থাকতো, তবে তাদের ফায়সালা হয়ে যেত। তাদের পর যারা কিতাব প্রাপ্ত হয়েছে, তারা অস্বস্তিকর সন্দেহে পতিত হয়েছে।”

রাসূলকে মানা ও অনুসরণ করার নামেই মানুষ যুগে যুগে বিভিন্ন ধর্ম চালু করেছে ও বিভক্ত হয়ে গেছে। আজকের মুসলমানরাও ধর্ম বলতে বোঝে পূজা-অর্চনার মতো নামাজ পড়া, রোজা রাখা, হজ করার মতো রিচুয়াল। আল্লাহ এগুলো করতে কুরআনে কোথাও বলেননি। এগুলো আজকের মুসলিমরা যে নিয়মে করে থাকে, তার বিন্দুবিসর্গ কোরআনে খুঁজে পাবেন না। আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইবাদত তথা দাসত্ব করার জন্য। ইবাদত তথা দাসত্ব হলো প্রভুর নির্দেশমতো কাজ করা। আল্লাহ এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি বস্তু ও প্রাণীর ভূমিকা বা কাজ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, যাকে ধর্ম বলা হয়। প্রত্যেক পদার্থেরই আলাদা আলাদা ধর্ম রয়েছে। প্রত্যেকে, এমনকি নাস্তিকেরাও, ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক, সেই ভূমিকা মেনে কাজ করে, মানে সিজদা করে, অর্থাৎ আল্লাহর হুকুম মেনে চলে। ১৩ নম্বর সূরা, ১৫ নম্বর আয়াত: “আল্লাহকে সিজদা করে যা কিছু নভোমণ্ডলে ও ভূমণ্ডলে আছে, ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায়, এবং তাদের ছায়াগুলিও সকাল‑সন্ধ্যায়।”

আমরা আল্লাহর দাস, কোনো রাসূল বা মানুষের দাস নই। আল্লাহ ধর্মীয় বিধিনিষেধ দেয়ার অধিকার কোনো নবী-রাসূল, পীর‑অলি-আউলিয়া, বুজুর্গকে দেননি। তেমনটি হলে আল্লাহর সাথে সাথে রাসূলও আমাদের উপাস্য হয়ে যাবে, যা তাওহীদের পুরোপুরি বিপরীত ও সাংঘর্ষিক। এরপরেও অধিকাংশ মানুষ রাসূলকে মান্য ও অনুসরণ করতে যেয়ে রাসূলের দাস বনে যায়, রাসূলের প্রশংসা করে, রাসূলের বন্দনাগীতি গায়, যেখানে সকল প্রশংসা হওয়া উচিত ছিল আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের। ‘আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামিন’—সকল প্রশংসা সমগ্র বিশ্বের প্রতিপালক মহান আল্লাহর। এজন্যই এ ব্যাপারে আল্লাহ কোরআনে সাবধান করে দিয়েছেন। তিন নম্বর সূরা আল-ইমরান, ৭৯ নম্বর আয়াত: “কোনো মানুষকে আল্লাহ কিতাব, হেকমত ও নবুয়ত দান করার পর সে বলবে যে, ‘তোমরা আল্লাহকে পরিত্যাগ করে আমার বান্দা হয়ে যাও’, এটা সম্ভব নয়। বরং তারা বলবে, ‘তোমরা আল্লাহওয়ালা হয়ে যাও, যেমন তোমরা কিতাব শিখাতে এবং যেমন তোমরা নিজেরাও পড়তে’।”

মজার ব্যাপার হলো, বিশ্বের ধর্ম অধ্যয়ন করলে তাদের মাঝে মিল পাওয়া যায়। প্রত্যেকেই নিজ নিজ মোল্লা, পুরোহিত, ঠাকুর, ফাদার, রাবাই, পাদ্রী, অলি-আউলিয়াদের দেখানো নিয়মে পূজা-অর্চনা করে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, খ্রিস্টানরা এই লাইনটা অতিক্রম করতে পারে না: ‘যীশু তাকে বললেন, আমি পথ, আমি সত্য ও জীবন। পিতার কাছে যাবার আমিই একমাত্র পথ।’ (পবিত্র বাইবেল, বুক অফ জন, চ্যাপ্টার ১৪, ভার্স ৬)। মুসলিমরা এই আয়াতটা ভালো করেই বোঝে যে, তাঁর সময়ে ঈসা এবং তাঁর সময়ে মোহাম্মদের আনুগত্য করা ছাড়া কেউই আল্লাহর কাছে আসতে পারে না। মুসলিমরা বলে যে, যীশুও একজন মুসলিম ছিলেন, কিন্তু তারা পল এবং অন্যদের গসপেল বা শিক্ষা প্রত্যাখ্যান করে, কারণ এটা ইঞ্জিল নয়, ঈসা কর্তৃক অনুমোদিত নয়। কিন্তু তাদের দ্বিচারিতা দেখা যায় যখন তারা খ্রিস্টানদেরকে তাদের বিশ্বাসে আমন্ত্রণ জানায় এবং তারপর তাদের কাছে বুখারী, তিরমিযী ইত্যাদি গসপেল সহ কুরআন ধরিয়ে দেয়।

রাসূলকে মানতে ও অনুসরণ করতে যেয়েই আজ মুসলিমরা বিশ্বের সবচেয়ে নিকৃষ্ট জাতিতে পরিণত হয়েছে। সেটা কীভাবে? আল্লাহর কথা আর রাসূলের কথার মধ্যে পার্থক্য করার ফলেই তাদের এ অবস্থা। চলুন, তাদেরই যুক্তি বিশ্লেষণ করি। বুখারী অনুসারীদের মতে, আল্লাহর আনুগত্য করা এবং রাসূলের আনুগত্য করা—দুটা ভিন্ন জিনিস। তারা নিজ মুখে দাবি করে যে, আল্লাহর আনুগত্য করা হলো আল‑কুরআন এবং রাসূলের আনুগত্য করা হলো রাসূলের হাদীস। এবার তারা আপনার সামনে কোরআনের এই আয়াতটা পেশ করবে, সূরা নিসা, আয়াত ৮০: “যে লোক রাসূলের হুকুম মান্য করবে, সে আল্লাহরই হুকুম মান্য করল।” এবার তাদের যুক্তি: অতঃপর কেউ যদি সহীহ আল‑বুখারীর হাদীস অনুসরণ করে, তার মানে সে রাসূলের আনুগত্য করেছে। আর যদি সে রাসূলের আনুগত্য করে থাকে, তবে সে আল্লাহর আনুগত্য করেছে। আল‑কুরআন কোথায় গেল? অবশেষে আল্লাহ ও তাঁর কোরআন থেকে উম্মত মুক্তি পেয়েছে! তাদের জন্য ইমাম বুখারী যথেষ্ট। শয়তান সফল।

উম্মতের এই যে অবস্থা হবে, তা আগেই কোরআনে সাবধান করা হয়েছে। ২৫ নম্বর সূরা ফুরকানের ৩০ নম্বর আয়াতে: “আর রাসূল বলবে, ‘হে আমার রব, নিশ্চয়ই আমার সম্প্রদায়, আমার কওম, এ কুরআনকে পরিত্যাজ্য গণ্য করেছে’।”

সূরা আরাফ, আয়াত ২‑৩: “এটি একটা গ্রন্থ যা আপনার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে, যাতে করে আপনি এর মাধ্যমে ভীতি প্রদর্শন করেন। অতএব, এটি পৌঁছে দিতে আপনার মনে কোনো রূপ সংকীর্ণতা থাকা উচিত নয়। আর এটি বিশ্বাসীদের জন্য উপদেশ। তোমরা অনুসরণ করো যা তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য আউলিয়াদের অনুসরণ করো না।”
সূরা আন‘আম, আয়াত ১৫৫: “এটি এমন একটা কিতাব যা আমি অবতীর্ণ করেছি, খুব মঙ্গলময়। অতএব, এর অনুসরণ করো এবং ভয় করো, যাতে তোমরা করুণাপ্রাপ্ত হও।”
সূরা আন‘আম, আয়াত ১৯: “আপনি জিজ্ঞেস করুন, সর্ববৃহৎ সাক্ষ্যদাতা কে? বলে দিন, আল্লাহ আমার ও তোমাদের মধ্যে সাক্ষী। আমার প্রতি এ কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে, যাতে আমি তোমাদেরকে এবং যাদের কাছে এ কোরআন পৌঁছে, সবাইকে ভীতি প্রদর্শন করি। তোমরা কি সাক্ষ্য দাও যে, আল্লাহর সাথে অন্যান্য উপাস্য রয়েছে? আপনি বলে দিন, আমি এরূপ সাক্ষী দেবো না। বলে দিন, তিনিই একমাত্র ইলাহ। আমি অবশ্যই তোমাদের শিরক থেকে মুক্ত।”

সুতরাং আমাদের কালেমা বলাটাই ভুল। ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর অর্থ কখনোই ‘উপাস্য নেই’ নয়। ‘ইলাহ’ মানে হচ্ছে বিধানদাতা, আর ‘উপাস্য’-র আরবি হচ্ছে ‘মাবুদ’। সূরা কাফিরুন পড়লেই আপনি বুঝতে পারবেন: ‘লা আ‘বুদু মা তা‘বুদুন’। ‘মাবুদ’ হচ্ছে উপাস্য, যার উপাসনা করা হয়। কিন্তু ‘ইলাহ’ কখনোই উপাস্য নয়। ‘ইলাহ’ হচ্ছে বিধানদাতা, আইনদাতা। ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ মানে হচ্ছে, আইন বা বিধান একমাত্র আল্লাহ দেবেন, কোনো নবী-রাসূল কেউ দেবেন না। নবী যদি কোনো আইন বা বিধান দেন, কোনো কিছুকে হালাল বা হারাম করেন, সূরা তাহরিমের এক নম্বর আয়াত পড়লেই আপনারা বুঝতে পারবেন যে, নবী-রাসূলের পক্ষেও আল্লাহর বিধান বা আইনের বাইরে কোনো আইন বা বিধান রচনা করা অসম্ভব ছিল।

মহান আল্লাহ আমাদের কালেমা উপলব্ধি করার তৌফিক দান করুক এবং ‘আল্লাহকে মানো ও রাসূলকে মানো’—এই আয়াতের মাধ্যমে ধর্মব্যবসায়ী মোল্লারা আমাদের যেভাবে আসমানি কিতাব, আল্লাহর রজ্জু থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে, সেখান থেকে আবারো হেদায়েতের আলোতে উদ্ভাসিত হওয়ার তৌফিক এনায়েত করুন।

আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামিন।

1 thought on “আল্লাহকে মানো রাসুলকে মানো ( ধর্মব্যবসার শুরু যেখানে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *